You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম ইমাম-উজ-জামান - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম ইমাম-উজ-জামান

ইমাম-উজ-জামান, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৫২) বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৫২ সালের ২৪শে মার্চ সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার উজানঢালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ডাক্তার মােছাদ্দের আলী চৌধুরী এবং মাতার নাম মাহমুদুন্নেসা বেগম। তাঁর পিতা চিকিৎসক হিসেবে চট্টগ্রামে বার্মা অয়েল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এ সুবাদে ইমাম-উজ-জামানের শৈশব কাটে চট্টগ্রামে। তিনি ১৯৬৭ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৯ সালে একই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে বিএসসি (অনার্স) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ২৪ ওয়ার ফোর্স-এ যােগদান করেন। এ বছরের ৫ই সেপ্টেম্বর কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কুমিল্লা সেনানিবাসে ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টে যােগদান করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইমাম-উজ-জামান কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকা শহরের পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু করলে এর প্রতিবাদে বাঙালি সামরিক, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও ছাত্র-জনতা বিদ্রোহ করে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করে। ২৬শে মার্চ আরাে তিনজন বাঙালি সেনা অফিসারসহ ইমাম-উজ-জামানকে পাকসেনারা কুমিল্লা সেনানিবাসে বন্দি করে রাখে। তাঁদের মধ্যে ক্যাপ্টেন জামান পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। ৩০শে মার্চ ইমাম-উজ-জামানসহ অপর তিনজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। দুজন বাঙালি অফিসার সঙ্গে-সঙ্গে শহীদ হন। ইমাম-উজ-জামান শরীরে তিনটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান এবং কৌশলে সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ৪ঠা এপ্রিল তিনি ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে মতিনগর বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত তিনি আগরতলা জিবি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ১৮ই এপ্রিল থেকে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ইমাম-উজ-জামান ২নং সেক্টরে, বিশেষকরে ফেনী-বিলােনিয়া অঞ্চলে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও নেতৃত্ব দেন। তিনি এ সেক্টরের রােঙ্গামুড়া সাব-সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন। ৭ই অক্টোবর ২নং সেক্টরে যুদ্ধরত নিয়মিত বাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন (৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, ৯ম ইস্ট বেঙ্গল এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) নিয়ে খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে বিগ্রেড আকারে ‘কে’ ফোর্স গঠন করা হলে তিনি ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার জাফর ইমাম, বীর বিক্রম-এর অধীনে আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধগুলাের মধ্যে সালদা বাজার যুদ্ধবিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার সালদা বাজার বিওপি ছিল পাকসেনাদের একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। এ ঘাঁটির মাধ্যমে তারা বিলােনিয়া রেলস্টেশন থেকে ফেনী পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। কৌশলগত দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এ ঘাঁটি আক্রমণ করে দখলে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ১৭ই নভেম্বর ইমাম-উজ-জামানের নেতৃত্বে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির মুক্তিযােদ্ধারা এ ঘাঁটি আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরাও পাল্টা আক্রমণ করে। তবে তারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম ফেলে পালিয়ে যায়। ফলে সালদা বাজার মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে চলে আসে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ইমাম-উজ-জামানেকে ‘বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৯১, খেতাবের সনদ নং ১৬)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তার কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৯৫ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ২০০০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিক)-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে এই বীর মুক্তিযােদ্ধার নামে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন গুলশান ২-এর ৫৫নং সড়কটির নতুন নামকরণ করে ‘বীর বিক্রম ইমামউজ-জামান সড়ক’। ব্যক্তিজীবনে মেজর জেনারেল (অব.) ইমাম-উজ-জামান দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তার স্ত্রীর নাম ইশরাত ইমাম। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড