ইয়াকুব বাহিনী
ইয়াকুব বাহিনী (মহম্মদপুর, মাগুরা) মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা একটি মুক্তিবাহিনী। এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সহযােগিতায় মাগুরা ও নড়াইলের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বাহিনীর প্রধান গােলাম ইয়াকুবের নামানুসারে এ বাহিনী ইয়াকুব বাহিনী নামে পরিচিতি পায়।
ইয়াকুব বাহিনীর প্রধান গােলাম ইয়াকুব মাগুরা জেলার মােহাম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের নারান্দিয়া গ্রামে। ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর আনসার বাহিনীতে কমান্ডার হিসেবে চাকরি নেন। এসময় বিশেষ পারদর্শিতার জন্য তিনি ইস্ট পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন কমান্ডার হিসেবে বন্দুক পুরস্কার পান। গােলাম ইয়াকুব ছিলেন অসীম সাহসী ও বিচক্ষণ এক গেরিলা কমান্ডার। তাঁর নেতৃত্বে নহাটা কেন্দ্রিক মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা সংগঠন ইয়াকুব বাহিনী গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা ও স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের বিবরণ অনুযায়ী নহাটা ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে ইয়াকুব বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৫০ জনের অধিক। এ বাহিনী ছিল মাগুরা ও নড়াইলে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নিকট মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস প্রায় সমগ্র মহম্মদপুর উপজেলা ছিল এ বাহিনীর তৎপরতায় অনেকটাই হানাদারমুক্ত এলাকা। একমাত্র উপজেলা সদর ও বিনােদপুর ব্যতীত অন্য কোথাও পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান করতে পারেনি। ইয়াকুব বাহিনীকে পর্যদুস্ত করার জন্য হানাদার বাহিনী কয়েকবার নহাটা আক্রমণ করে। কিন্তু প্রতিবারই পাকস্তানি বাহিনী পরাস্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। গােলাম ইয়াকুব ও তাঁর বাহিনী এপ্রিলের শুরুতে মহম্মদপুর থানায় প্রায় অস্ত্রহীন অবস্থায় আক্রমণ করে। তাঁরা কৌশলে থানার মােতালেব দারােগাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন এবং থানার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ১টি রিভলবার, ১৮টি ৩০৩ রাইফেল ও গােলাবারুদ হস্তগত করেন। ২১শে আগস্ট নহাটা মডেল স্কুল মাঠে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ইয়াকুব বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। ভয়াবহ এযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য নিহত হয়। ২২শে আগস্ট হানাদার বাহিনী কামানসহ নহাটা বাজার আক্রমণ করলে গােলাম ইয়াকুব ও তার বাহিনী এক অভূতপূর্ব যুদ্ধকৌশলে হানাদার বাহিনীকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে বাজারে সমবেত বহুসংখ্যক মানুষের জীবন রক্ষা করেন। এছাড়াও ইয়াকুব বাহিনী ৪ঠা অক্টোবর বিনােদপুর যুদ্ধ, ১৬ই অক্টোবর জয়রামপুর যুদ্ধ এবং ১৯শে নভেম্বর মহম্মদপুর সদরের যুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। সকল যুদ্ধেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ইয়াকুব বাহিনীর নিকট পর্যদুস্ত হয়। যুদ্ধকৌশলের কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীত সম্পূর্ণ স্ব-উদ্ভাবিত রণকৌশল দ্বারা ইয়াকুব বাহিনী উচ্চ প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি অফিসারদের রণকৌশলকে বারবার নস্যাৎ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার দেশের গােলাম ইয়াকুবকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। [সৈয়দ হাদিউজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড