ইটনা থানা আক্রমণ
ইটনা থানা আক্রমণ (ইটনা, কিশােরগঞ্জ) হয় ১৫ই নভেম্বর। এর ফলে থানার রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে এবং ইটনা শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশােরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বেশ তৎপরতা ছিল। ইটনা থানাকে কেন্দ্র করে রাজকারদের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতাে। ফলে ইটনা থানায় আক্রমণ করে রাজাকারদের নানা ধরনের অপতৎপরতা থেকে এ এলাকার মানুষকে মুক্ত করা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অক্টোবরের প্রথমদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইটনা থেকে চলে যায়। ইটনার রাজাকাররা তখন নিজেদের রক্ষার কৌশল হিসেবে মুক্তিযােদ্ধা পরিবারগুলােকে জিম্মি রাখার কৌশল গ্রহণ করে। তারা প্রচার করে যে, মুক্তিযােদ্ধারা যদি ইটনা আক্রমণ করে তবে সর্বাগ্রে তাদের ঘনিষ্ঠজনদের হত্যা করা হবে। রাজাকারদের এ-ধরনের ঘােষণা সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধারা ইটনা আক্রমণ করার জন্য নভেম্বরের প্রথমদিকে ইটনা সদরের ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে ভয়রা গ্রামে সমবেত হন। এ সংবাদ পেয়ে ইটনায় রাজাকারের প্রধান সংগঠক দেওয়ান আব্দুর রহিম ভয়রা গ্রামে আসে। সে রাজাকারদের নিয়ে আত্মসমপর্ণ করার অঙ্গীকার করে। তবে এজন্য কিছুদিন সময় প্রার্থনা করে। মুক্তিযােদ্ধারা কয়েকটি শর্তে তার এ প্রস্তাবে সম্মত হন। শর্তগুলাে ছিল রাজাকাররা ক্যাম্প থেকে বের হতে পারবে না, তারা যে সমস্ত গবাদি পশু লুট করেছে সেগুলাে ফেরত দিতে হবে, দালাল আ. মান্নান, মানিক মিল্কী ও থানার স্বঘােষিত ভারপাপ্ত কর্মকর্তা ও রাজাকার কমান্ডার আবু তাহের ইউসুফী কোনােক্রমেই ইটনা থেকে পালাতে পারবে না এবং সমস্ত পাহারা চৌকি থেকে রাজাকারদের প্রত্যাহার করে মূল ক্যাম্পে ফেরত আনতে হবে। এসব শর্ত লঙ্ঘিত হলে যে-কোনাে মুহূর্তে ইটনা থানা আক্রমণ করা হবে এবং মারাত্মক পরিণতি ভােগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।
কয়েকদিন পর এসব শর্ত ভঙ্গ করে রাজাকাররা টহল, লুটপাট ও চাঁদাবাজি শুরু করে। কিছু রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ধরাও পড়ে। খােরশেদ-সহ কয়েকজন রাজাকার আহত অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। এলাকার অন্যতম প্রধান রাজাকার আ. মান্নান ভূঞা ইটনা থেকে পালিয়ে যায়। শর্তগুলাে সম্পূর্ণ লজ্জিত হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা ইটনা আক্রমণের জন্য ছিলনী গ্রামে সমবেত হন। ইটনার বীর মুক্তিযােদ্ধা হাবিবুর রহমান ঠাকুর এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। ১৫ই নভেম্বর গভীর রাতে ৪টি দলে ভাগ হয়ে ইটনায় ঝটিকা আক্রমণ চালানাে হয়। হাবিবুর রহমান ঠাকুর নিজে দেওয়ান বাড়ি, আফতাব উদ্দিন খান ও মাে. রওশন আলী রুশাে পশ্চিমগ্রাম রাজাকার ক্যাম্প, জাহাঙ্গীর আলীম ভূঞা ইটনা থানা এবং মাে. নজরুল ইসলাম ঠাকুর পূর্বগ্রাম ওয়ারলেস ক্যাম্পের রাজাকারদের বন্দি করেন। ভীত-সন্ত্রস্ত ৮ জন রাজাকার কমান্ডার ও শতাধিক রাজাকার অস্ত্র সমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে ইটনা মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। তবে পরে ঢালাছত্রিশ, ধােবাজোড়া এবং বােরনপুর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নায়ক আবু তাহের ইউসুফীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও তা কার্যকর করা হয়। রাজাকারদের দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যারা চাপে পড়ে রাজাকার হয়েছিল কিন্তু কোনাে অপকর্মে লিপ্ত হয়নি তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু যারা স্বপ্রণােদিত হয়ে রাজাকার হয়ে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণে লিপ্ত ছিল, জনতার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাদের চরম দণ্ড দেয়া হয়। কিছুদিন পর ইটনা গণহত্যার প্রধান নায়ক আ. মান্নান মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে এবং কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি সে পায়। ১৫ই নভেম্বর ভােরে গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে ইটনা থানায় বাংলাদেশের লাল-সবুজের বিজয় পতাকা উত্তোলিত হয়। [মাে. রওশন আলী রুশাে]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড