ইতনা গণহত্যা
ইতনা গণহত্যা (লােহাগড়া, নড়াইল) সংঘটিত হয় ২৩শে মে। এতে ৭৫ জন নারী-পুরুষ নিহত হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে গােপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ভাটিয়াপাড়া পাকসেনাছাউনি থেকে হানাদাররা প্রতিদিন কোনাে-না-কোনাে অঞ্চলে হামলা চালাত, লােকজনদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগাত, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করত এবং নদীতীরবর্তী বাড়িঘরে গিয়ে নারী ধর্ষণ করত। দালালচক্রের সরবরাহ করা গােপন তথ্যের ভিত্তিতে হানাদাররা ভাটিয়াপাড়া থেকে অপারেশনে বের হতাে। এমনি একটি অপারেশন ইতনা গণহত্যা। ইতনা থেকে নদীপথে ভাটিয়াপাড়ার দূরত্ব ২ থেকে সােয়া ২ মাইল।
এপ্রিল মাসে লােহাগড়া উপজেলার মধুমতি নদীর তীরে প্রাচীন গ্রাম ইতনায় একটি মুক্তিযােদ্ধা দল গড়ে ওঠে। সেখানে কয়েক শত লােককে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ভাটিয়াপাড়ায় অবস্থিত সেনাছাউনির কর্মকর্তারা দালালদের মাধ্যমে গােপন সূত্রে খবরটি জানতে পারে। ১৫ই মে বিরাট শক্তিসামর্থ্য নিয়ে পাকবাহিনী ইতনায় প্রথম হামলা চালায়। তারা মধুমতি নদীর তীরে নেমে বসতবাড়ি লক্ষ করে গুলি চালায়। বিভিন্ন বাড়িতে প্রবেশ করে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগায়। হাজারহাজার মানুষের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি করে। অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। ইতনা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় হিমায়েতুল ইসলাম ধলু, পেনু ঘােষ ও অতুল পাল নিহত হয়। অতুল পালকে হানাদাররা জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারে।
লােহাগড়া উপজেলার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীর অপর পাড়ে কাশিয়ানি উপজেলার একটি গ্রাম চরভাটপাড়া। ২২শে মে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিতে হামলা চালায়। হামলাকালে হানাদার বাহিনী নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। প্রত্যক্ষদর্শী অনিল কাপালি নামক এক ব্যক্তি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক পাকসেনার রাইফেল কেড়ে নিয়ে দৌড়ে মধুমতি নদীতে ফেলে দেয়। ঘটনার পর অনিল আত্মরক্ষার্থে কোনােভাবে মধুমতির তীরে আত্মগােপন করে। পাকবাহিনী ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে পুনরায় বিকেলে চরভাটপাড়ায় ফিরে আসে। রাইফেল উদ্ধারের নামে তারা চরভাটপাড়া গ্রামের লােকজনদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে তারা জানতে পারে যে, রাইফেল ছিনতাইকারীর বাড়ি ইতনা গ্রামে।
২৩শে মে হানাদার বাহিনী ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প থেকে গানবােট নিয়ে ইতনা গ্রামের দিকে দ্বিতীয়বার অগ্রসর হয় এবং তীরে নেমে গুলি করতে-করতে গ্রামে প্রবেশ করে। তাদের সামনে পড়ে এক পাগল। পাকসেনাদের ছােড়া গুলি তার বুক ভেদ করে যায়। গ্রামবাসী হানাদারদের রুখতে তাদের দেশীয় অস্ত্র ঢাল, সড়কি ও বল্লম দিয়ে প্রতিরােধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। বাঞ্ছারাম মণ্ডল নামে এক গ্রামবাসী হানাদারদের ছােড়া গুলি ঠেকাবার চেষ্টা করলে রাইফেলের গুলি তার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। ইপিসিপি-র স্থানীয় নেতা শেখ হাফিজুর রহমান হিরু মিয়াকে দেখামাত্র হানাদাররা তাকে গুলি করে হত্যা করে। সুফিয়া নামের এক মহিলার সামনে তার ৪ পুত্র সন্তানকে হত্যা করা হয়। বাঁচার জন্য ইতনা গ্রামের মমিন উদ্দিনের পুত্র শেখ তবিবর রহমান টুপি মাথায় দিয়েছিল। তার ধারণা ছিল মুসলমান জানলে তাকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু হানাদাররা তাকেও রেহাই দেয়নি। গুলিতে তার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আরেক শহীদ মাে. হিমায়েত হােসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার গায়ে যতবার গুলি করা হয় ততবার সে ‘জয় বাংলা উচ্চারণ করে পরিশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মােল্লা আবদুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। তাকেও কোরআন পাঠরত অবস্থায় হানাদার বাহিনী হত্যা করে। মাে. নবির শেখ নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পানি-পানি করতে-করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার ৪ পুত্র কাওছার আলি, শওকত আলি, এছমত আলি ও মােশাররফ আলিকেও হত্যা করা হয়। হানাদাররা ইতনা গ্রামের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে আগুনের মধ্যে লােকদের ছুড়ে ফেলে। আগুনের লেলিহান শিখায় নিমেষে তাদের দেহ ভস্মীভূত হয়ে যায়।
২৩শে মে সংঘটিত ইতনা গণহত্যায় মােট ৭৫ জন নরনারী হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। পূর্বে উল্লিখিতদের ছাড়াও ৩০ জনের নাম পরিচয় জানা গেছে। তারা হচ্ছেন- শিকদার ওয়ালিউর রহমান, মােল্যা মােখলেসুর রহমান, শিকদার হাবিবুর রহমান, মাে. রাশেদ গাজি, মাে. বাদল শেখ, মাে. হারেছ ফকির, মাে. তারু মিয়া, মাে. রবি মােল্যা, মাে. হাসান মােল্যা, মাে. পাচু মিয়া খদগির, মাে. মতলুব শেখ, মাে. লালু খাঁ, শেখ রফিউদ্দিন (লেংটা মিয়া), মােল্যা কেয়ামদ্দি (কিনু ফকির), মাে. নুরুদ্দিন শেখ, মির্জা মােবারক হােসেন, মাে. নুরু মিয়া, মাে. কুটি মিয়া মােল্যা, কানাই স্বর্ণকার, মােল্যা আবদুর রাজ্জাক, মােল্যা রফিউদ্দিন আহমদ, মােল্যা মনসুর আহমদ, মাে. মালেক শেখ, শিকদার হাদিয়ার রহমান, মাে. ফেলু শেখ, মাে. মােহন কাজি (পাগলু কাজি), মাে. আতিয়ার শেখ, মাে. জহুর শেখ, শিকদার সরােয়ার রহমান (লেংটা) ও মাে. বাকু শেখ। আহত হয় দেড়শত লােক। আহতরা বিনা চিকিৎসায় ধুকেধুকে মারা যায়। এ হত্যাকাণ্ডের পর সমস্ত মানুষ ইতনা ছেড়ে পালিয়ে যায়। শহীদদের সমাহিত করার কেউ ছিল না। এক পর্যায়ে ২-১ জন করে লােক গ্রামে প্রবেশ করে। তারা কোনােরকমে একই কবরে পাঁচ-সাতজনকে সমাহিত করে নিজেদের জীবন নিয়ে ইতনা থেকে পালিয়ে যায়। এই শহীদদের কাফনের কাপড় জোটেনি, জানাজা বা সত্তার কোনােটিই হয়নি।
১৯৯৩ সালের ২৪শে নভেম্বর ইতনার দুই তরুণ চিত্রশিল্পী নারায়ণ বিশ্বাস এবং আলী আজগর রাজা ‘স্বাধীনতা শহীদ তিথি’ নামে ২৩শে মে সংঘটিত ইতনার শহীদদের স্মরণে একটি চিত্রমেলার আয়ােজন করেন। এই চিত্রমেলায় তাদের ৫০টি চিত্রকর্ম স্থান পায়। ইতনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হলঘরে এই মেলার উদ্বোধন করেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। ১৯৯৪ সালে ইতনা গণগ্রন্থাগারের উদ্যোগে সর্বপ্রথম শহীদদের নামে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ২৩শে মে ইতনা গণগ্রন্থাগার স্বাধীনতার এই বীর শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছে। [মহসিন হােসাইন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড