You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক আহসান উল্লাহ

আহসান উল্লাহ, বীর প্রতীক (১৯৪২-২০০৭) সাবমেরিনার এবং ১৫ই আগস্ট অপারেশন জ্যাকপট-এর অধীন মংলা বন্দরে নৌকমান্ডাে অপারেশনে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৪২ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ফেনী জেলার সােনাগাজী উপজেলার আহমেদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আমিন উল্লাহ ও মাতার নাম জরিফা খাতুন। তিনি স্থানীয় মঙ্গল কান্দি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা।
১৯৬৮ সালের ১৩ই ডিসেম্বর তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যােগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ফ্রান্সের তুলো নৌঘাটিতে অবস্থান করছিলেন। এসময় তিনি পাকিস্তানের কমিশন করা সাবমেরিন ‘ম্যানগ্রো’-তে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় বাংলাদেশের খবরাখবর জানতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিসহ ৮ জন বাঙালি সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন।
আহসান উল্লাহ ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশীর নৌকমান্ডাে ক্যাম্পে আত্মঘাতী কমান্ডােদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি ১৫ই আগস্ট অপারেশন জ্যাকপটের অধীন মংলা বন্দরে আত্মঘাতী ৪৮ জন নৌকমান্ডাে দলের নেতৃত্ব দেন। ১৪ই আগস্ট দলনেতা আহসান উল্লাহ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের কাছে থাকা রেডিও অন করে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে কান পেতে থাকেন। ঐদিন এ কেন্দ্র থেকে অপারেশনের সংকেত হিসেবে একটি গান বাজার কথা, যা অধিনায়ক হিসেবে শুধু তিনিই জানতেন। ঠিক সকাল সাড়ে ৭টায় তিনি শুনতে পান পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে সেই কাঙ্ক্ষিত গান, ‘আমার পুতুল আজকে যাবে প্রথম শ্বশুরবাড়ি’। গানটি শুনে দ্রুত সহযােদ্ধা নৌকমান্ডােদের জানান, আজ রাতেই হবে তাঁদের প্রতীক্ষিত অপারেশন। এরপর সারাদিন গােপন আশ্রয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সন্ধ্যার পর ৫-৬ কিমি দূরে লক্ষ্যস্থলের দিকে রওনা হয় কমান্ডাে দল। ১৫ই আগস্ট ভাের সাড়ে ৪টায় তারা লক্ষ্যস্থল মংলা বন্দরে পৌঁছান এবং দ্রুত বুকে মাইন বেঁধে ও পায়ে ফিনস্ পরে নিঃশব্দে পানিতে নেমে পড়েন। পশুর নদীর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে জাহাজ ছড়িয়ে ছিল। পানিতে নেমে নৌকমান্ডােরা কোনাে জাহাজের জন্য একজন কোনাে জাহাজের জন্য দুজন – এভাবে ছড়িয়ে পড়েন। আগস্ট মাসের এদিন নদীতে বিশাল ঢেউ নৌকমান্ডােদের নাক-মুখের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল। অপরদিকে বন্দর এবং জাহাজের সার্চলাইটের আলাের ঝলকানির মধ্যে তারা এগিয়ে যেতে থাকেন। তারা সফলতার সঙ্গে বেশিরভাগ জাহাজের গায়ে লিম্পেট মাইন সংযুক্ত করেন। সময় ক্ষেপণ না করে এরপর তারা সাঁতরে নিরাপদ স্থানে চলে যান। তখন ভাের প্রায় সাড়ে ৫টা। মাঝনদীতে বিকট শব্দে প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে। দু-তিন মিনিট পর আরেকটি। মুহূর্তের মধ্যে সমগ্র নদীতে ৭-৮ মিনিট ধরে চলতে থাকে মাইন বিস্ফোরণ। ৩৫-৪০টি মাইনের কান ফাটানাে শব্দে বন্দরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে ছােটাছুটি করতে থাকে। এ অভিযানে সমুদ্রগামী ৮-১০টি জাহাজ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সমরাস্ত্র ও রসদ সামগ্রীবাহী সােমালিয়ান বৃহদাকার জাহাজ এস এস লাইটিং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও তিনি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অপারেশন-এ অসামান্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। যুদ্ধের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডােদের অপারেশন জ্যাকপট এক বিস্ময় উদ্রেককারী ঘটনা। দুঃসাহসিক এ সফল অভিযান সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাবমেরিনার আহসান উল্লাহর বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চাকরিতে বহাল হন। ২০০৭ সালের ৭ই জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিজ বাড়ি আহমেদপুরে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম নূরজাহান বেগম। এ দম্পতি ৩ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!