অ্যালেন গিন্সবার্গ
অ্যালেন গিন্সবার্গ (১৯২৬-১৯৯৭) প্রথাবিরােধী মার্কিন কবি, লেখক ও গীতিকার, ৫০-এর দশকের নতুন সংস্কৃতি ‘বিট জেনারেশন’-এর অন্যতম ব্যক্তিত্ব, সেপ্টেম্বর অন যশাের রােড নামে বিখ্যাত কবিতার রচয়িতা, মুক্ত ও স্বাধীনচেতা এক প্রতিবাদী কণ্ঠ, মানবাধিকারে বিশ্বাসী, পুঁজিবাদের বিরূপ ফলাফলের কঠোর সমালােচক, যুদ্ধবিরােধী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কবিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯২৬ সালের ৩রা জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি স্টেটের নেওয়ার্ক-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম লুইস গিন্সবার্গ ও মাতার নাম নওমি লিভারগ্যান্ট গিন্সবার্গ। পিতা ছিলেন কবি ও স্কুল শিক্ষক। নিউ জার্সির প্যাটারসন এলাকায় অ্যালেন গিন্সবার্গের শৈশব কাটে। তিনি ইস্টসাইড হাইস্কুল এবং মন্টক্লেয়ার কলেজে পড়াশুনা শেষে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের লক্ষ্যে তিনি কিছুকাল বাণিজ্যিক জাহাজে চাকরি করেন। কলম্বিয়ায় থাকাকালে তিনি কলম্বিয়া সাহিত্য জার্নালসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা দেন এবং সাহিত্য বিষয়ক সােসাইটির সদস্য হন। ১৯৫৫ সাল থেকে তিনি কবিতা লেখায় সম্পূর্ণ মনােনিবেশ করেন। উল্লেখ্য, স্কুল জীবনে তিনি ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা পড়ে আকৃষ্ট হন। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম মহাকাব্য হাউল, যা তার জন্য বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি এনে দেয়। ক্যাডিশ (১৯৫৭) তাঁর অপর বিখ্যাত মহাকাব্য। গিন্সবার্গ নতুন ধারার কবিতা নিয়ে আমেরিকার বাইরে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও ভারত সফর করেন। ১৯৬৫ সালে লন্ডনের রয়েল আলবার্ট হলে আন্তর্জাতিক কবিতা পাঠের আসরে তাঁর কবিতা আবৃত্তি করে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৬২-৬৩ সময়কালে ভারতবর্ষে আসেন। সে-সময় অধিকাংশ সময় কাটান কলকাতায়। সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায় চৌধুরীসহ অনেক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। দ্বিতীয়বার তিনি ভারতে আসেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। উদ্দেশ্য, ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের করুণ অবস্থা স্বচক্ষে দেখা এবং কবিতার মাধ্যমে তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা।
৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্দেশে সেদেশের সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাঙালিদের হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা হত্যার পাশাপাশি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযােগ ও তা ধ্বংস, নারীর ওপর পাশবিক নিযার্তন ইত্যাদি চালিয়ে এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করে, যা ৯ মাস ধরে চলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও নিষ্ঠুর আচরণে সহায়-সম্বলহীন মানুষ দলে-দলে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহে আশ্রয় নিতে থাকে। শরণার্থীদের সেই অগণিত মিছিলে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ কেউ বাদ ছিল না। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ১ কোটি জীবন-বিপন্ন বাঙালি ভারতের শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় গ্রহণ করে। এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া যেকোনাে রাষ্ট্রের পক্ষেই ছিল অত্যন্ত দুরূহ। অতএব এসব শরণার্থীকে এক কঠিন সময়ের মুখােমুখি হতে হয়। শরণার্থী শিবিরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মানুষকে খােলা আকাশের নিচে ঠাই নিতে হয়। কেউ-কেউ আশ্রয় নেয় বড়বড় সুয়ারেজ পাইপের ভেতর। সেখানে ছিল খাদ্য, ঔষধ, শিশুখাদ্য ও স্যানিটেশনের প্রকট সমস্যা। এর ওপর জুনজুলাই মাসে ঘটে মহামারী আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব। তা অগণিত শিশু, নারী ও বৃদ্ধের জীবন কেড়ে নেয়। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও ভারতের শরণার্থী শিবিরে লক্ষলক্ষ বাঙালির করুণ অবস্থা বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়। যুক্তরাজ্যের সঙ্গীত শিল্পী ও গীতিকার জর্জ হ্যারিসন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গীত শিল্পী বব ডিলন, চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন, ফোক গায়িকা জোয়ান বায়েজ, প্রথাবিরােধী প্রতিবাদী কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, রাশিয়ার কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনিস্ক, আর্জেটিনার খ্যাতনামা কবি ও রবীন্দ্র অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাে, ফ্রান্সের মানবতাবাদী লেখক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ আঁদ্রে মালরাে, সুইডেনের বিখ্যাত লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী গুনার মিরডাল, ভারতের বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হােসেন প্রমুখ সে সময় নিজ-নিজ অবস্থান থেকে বিপন্ন বাঙালিদের পাশে দাঁড়ান।
রেডিও-টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে অ্যালেন গিন্সবার্গ বাঙালি শরণার্থীদের করুণ অবস্থা সম্বন্ধে জানতে পারেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড যুদ্ধবিরােধী ও মানবতার পক্ষে আজীবন সংগ্রামী। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন প্রশাসনের যুদ্ধনীতির তীব্র বিরােধিতা করে তিনি নওম চমস্কি ও অন্যান্য লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ‘A call to Resist Illegitimate Authority প্রচারপত্রে স্বাক্ষর করেন। যুদ্ধের জন্য ধার্যকৃত বিশেষ ট্যাক্স প্রদানেও তিনি অস্বীকৃতি জানান। আমেরিকার রাস্তায়-রাস্তায় ও পার্টির জাতীয় কনভেনশনে সহকর্মীদের নিয়ে প্রতিবাদের আয়ােজন করেন। তাই বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুঃখ-বেদনা গিন্সবার্গের সংবেদনশীল মনকে গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করে। তিনি নীরব থাকতে পারেননি। তাই ছুটে আসেন সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের পশ্চিম বাংলায়।
বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে শরণার্থী শিবিরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। তখন চলছিল বন্যা ও ভারী বৃষ্টিপাত। অনেক রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গিয়েছিল। তাই নৌকায় করে দুই বন্ধু বনগাঁ অতিক্রম করে বাংলাদেশের যশাের সীমান্তে এসে পৌঁছেন। এখানে শতশত বাঙালি শরণার্থীদের যশাের রােড ধরে কলকাতা যাওয়া তারা প্রত্যক্ষ করেন। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ৬৭ মাইল (১০৮ কিমি) দীর্ঘ যশাের রােড বাংলাদেশকে পশ্চিম বাংলা (ভারত)-র সঙ্গে যুক্ত করে। সারিবদ্ধ বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আগমন ও কলকাতায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলােকে অ্যালেন গিন্সবার্গ লেখেন তাঁর বিখ্যাত ‘September on Jessore Road কবিতা। অকালে মৃত তরুণ ও প্রতিশ্রুতিশীল বাঙালি কবি খান মােহাম্মদ ফারাবী (১৯৫২-১৯৭৪) সুদীর্ঘ মূল কবিতাটি অনুবাদ করেন। কবিতাটির শেষের ৬ লাইন-
শত শত মুখ হায় একাত্তর
যশাের রােড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।
কবিতাটিতে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি বােমারু বিমানের আঘাতে ছিন্নভিন্ন মানুষের ঘরবাড়ি, দেহ, আধমরা মুখে শতশত দলে কর্দমাক্ত রাস্তায় পায়ে হেঁটে, বন্যা-বৃষ্টির পানি ঠেলে, কেউ-কেউ গরুর গাড়িতে চড়ে কলকাতার উদ্দেশে
মানুষের ঢল, পথে-পথে অনেকের মৃত্যু, বাঁশের ছাউনিতে কাদামাটি জলে তৈরি আশ্রয় শিবির, আধপেটা শিশু কোলে জননীর খাবারের আকুতি, শতশত নারী, শিশু ও বৃদ্ধের খােলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়া, আশ্রয় শিবিরে অসংখ্য মানুষ বিশেষ করে শতশত শিশুর মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা যে-যেকোনাে মানুষের হৃদয়কে গভীর মমতায় এখনাে স্পর্শ করে।
বাঙালি শরণার্থীদের দুঃখভরা অবর্ণনীয় করুণ জীবনস্মৃতি সঙ্গে নিয়ে গিন্সবার্গ নিজ দেশ আমেরিকায় ফিরে যান এবং বন্ধু রাশিয়ার কবি আন্দ্রেই ভজনেসনিস্ককে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন ও বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে তাঁর নিজের কবিতাটিসহ অন্যান্য কবিতা পাঠের আয়ােজন করেন। তিনি নিজে কবিতায় সুর দেন। তাঁর বন্ধু বিখ্যাত পপ সঙ্গীত শিল্পী বব ডিলান যন্ত্রে কবিতায় সুর তােলেন। ‘মুক্তির গান’-এর খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকর তারেক মাসুদ (১৯৫৬-২০১১) তার একটি চলচ্চিত্রে পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতাটি গান আকারে ব্যবহার করেন। গানটি সিডি আকারেও প্রকাশিত।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বজনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ অ্যালেন গিন্সবার্গ-কে Friends of Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রদান করে। এ সংক্রান্ত সাইটেশনে বলা হয়মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রতিবাদী কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে নিদারুণ অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করে ‘সেপ্টেম্বর অন যশাের রােড’ শীর্ষক কিংবদন্তি কবিতা রচনা করেন। কবিতায় তিনি শরণার্থীদের দুঃসহ জীবন, তাদের ওপর পাকসেনাদের অত্যাচার এবং শরণার্থী শিবিরগুলােতে প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানির চিত্র অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন, যা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল। বিশ্ব জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ অ্যালেন। গিন্সবার্গ-কে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হল।
অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রথার বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী, প্রতিবাদী ও সৃষ্টিশীল অসাধারণ কবিতা রচনার মাধ্যমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড (যৌথভাবে), ১৯৭৯ সালে ন্যাশনাল আর্টস ক্লাব গােল্ড মেডেল, ১৯৯৫ সালে পুলিজার প্রাইস বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি ১৯৯৭ সালের ৫ই এপ্রিল ৭০ বছর বয়সে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Allen_Ginsberg http://www.everyday-beat.org/ginsberg/poems/jessore.txt; https://www.amrabondhu.com/monir-hussain/3758
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড