You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক আশরাফুল হক

আশরাফুল হক, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৭) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের বাদুরতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাবিবুল হক এবং মাতার নাম আঞ্জুমান আরা বেগম।
আশরাফুল হক রাজনৈতিকভাবে বেশ সচেতন ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের শােষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি সক্রিয় ছিলেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ- বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় এবং বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরাে বাড়িয়ে দেয়। ৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর আশরাফুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমেই তিনি এলাকার ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধে অংশ নেন।
প্রতিরােধ যুদ্ধের পর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ভারতে যান এবং প্রথমে মেলাঘর ও পরে ইন্দ্রনগরে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিনি ৪নং সেক্টরে সি আর দত্তের অধীনে সিলেট জেলার বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন। ২২শে সেপ্টেম্বর আশরাফুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা জকিগঞ্জ উপজেলায় হানাদার বাহিনীর আটগ্রাম ডাকবাংলাে ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এ ক্যাম্পে পাকিস্তানি সৈন্য, ইপিসিএএফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিলিয়ান আমর্ড ফোর্সের্স) ও তাদের সহযােগী রাজাকারসহ ৫০-৬০ জন অবস্থান করত। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ছিল আটগ্রামের কাছাকাছি নিতনপুরে। তাঁরা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন, যার একটির নেতৃত্বে ছিলেন আশরাফুল হক। অপর দুটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মাহবুবর রব সাদী, বীর প্রতীক এবং নিজামউদ্দীন, বীর উত্তম। রাত ১টায় একটি দল আটগ্রামের পার্শ্ববর্তী কারবাল্লা গ্রামে অবস্থান নেয়। অপর দুটি দল কুশিয়ারা নদী পাড় হয়ে একটি ডান দিকে, অপরটি বাম দিকে এগিয়ে যায়। আশরাফুল হকের নেতৃত্বে তার দলটি নির্বিঘ্নেই পৌছে যায় লক্ষ্যস্থল ডাকবাংলাের নিকটে। তাঁদের হাতে অস্ত্র বলতে ২টি এলএমজি, বাকি সব স্টেনগান ও রাইফেল। নির্ধারিত সময় রাত ৪টার পূর্বেই তাঁদের আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
ভারত থেকে যৌথবাহিনীর দূরপাল্লার গােলাবর্ষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আশরাফুল হক সহযােদ্ধাদের নিয়ে প্রচণ্ডভাবে হানাদারদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। একই সঙ্গে অন্য দুটি দলও আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। যুদ্ধের শুরতেই রাজাকাররা এবং শেষদিকে হানাদার সৈন্যরাও পালিয়ে যায়। যুদ্ধে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়, অপরদিকে ৮ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধ শেষে হানাদারদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধারা হস্তগত করেন। আশরাফুল হক হাতে এবং পায়ে গুলিবিদ্ধ হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যান। যুদ্ধের শেষদিকে তার কোমরে শেলের স্প্রিন্টার বিদ্ধ হয়। সহযােদ্ধারা তাকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য ভারতে প্রেরণ করেন। গৌহাটি হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি ৩রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ এসে পুনরায় যুদ্ধে অংশ নেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আশরাফুল হক-কে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তিনি নিজ এলাকায় পৈতৃক বাড়িতে অবস্থান করতেন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা চালাতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শাহীন সুলতানা। এ দম্পতির ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে। ১৯৯৭ সালের ২রা জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!