You dont have javascript enabled! Please enable it!

আলীশ্বর যুদ্ধ

আলীশ্বর যুদ্ধ (লাকসাম, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ১৪ই এপ্রিল বুধবার। এদিন লাকসাম রেলওয়ে জংশনের উত্তরে অবস্থিত আলীশ্বর নামক স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে যে সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তা আলীশ্বর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ১৫০-২০০ জনের মতাে পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে ২ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধশেষে পাকসেনারা একাধিক গ্রামের বহু বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ করে এবং ৫০ জনের অধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
লালমাই প্রতিরােধ যুদ্ধের পর ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কিছু মুক্তিযােদ্ধা ভারতে অস্ত্র সংগ্রহ করতে যাওয়ার ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতায় সামান্য বিরতি ঘটে। এ সুযােগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লাকসামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন লাকসাম-বাগমারা ও এর আশপাশের এলাকার নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতা মিলে ১০০ জনের অধিক প্রতিরােধযােদ্ধা আলীশ্বরে প্রতিরােধ গড়ে তােলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে নােয়াখালীর দিক থেকে আসা কিছু পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও সেনাসদস্য যােগ দেন। এ প্রতিরােধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন। মাহবুবুর রহমান, ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। আলীশ্বরের প্রতিরােধ যুদ্ধের পূর্বে মুক্তিযােদ্ধারা লাকসামে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। লাকসাম রেলওয়ে জংশনের টিসি অফিসটি তখন চাঁদপুর, নােয়াখালী ও ফেনীসহ অন্যান্য অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান কন্ট্রোল রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৩ই এপ্রিল বিকেল থেকে মুক্তিযােদ্ধারা আলীশ্বর এলাকার বিভিন্ন স্থানে বাঙ্কার খুঁড়ে প্রতিরােধের জন্য প্রস্তুত হন।
পাকিস্তানি সৈন্যরা ১৪ই এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ১০০০ জনের অধিক সৈন্য নিয়ে আলীশ্বরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আসার পথে তারা নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে এবং রাস্তার দুপাশের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ছিল আলীশ্বর রেলস্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে ডাকাতিয়া নদীর পাড় পর্যন্ত। পাকিস্তানি সৈন্যরা রেললাইন, সিএন্ডবি রােড এবং ডাকাতিয়া নদীর গা ঘেঁষে আলীশ্বর হয়ে লাকসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা আলীশ্বর পর্যন্ত এগিয়ে এলে পূর্ব থেকে প্রস্তুত থাকা মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এ-যুদ্ধ ৩ ঘণ্টার মতাে। স্থায়ী হয়। বিশাল পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হন এবং দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ পূর্ব দিকে ও অন্য অংশটি দক্ষিণ দিকে চলে যায়। আলীশ্বর যুদ্ধে ১৫০২০০ জনের মতাে পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে ২ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্য এ দুজন মুক্তিযােদ্ধা হলেন নােয়াখালীর সেনবাগের আবদুল মান্নান ও বরিশালের রফিকুল ইসলাম। প্রতিরােধ যুদ্ধ শেষে পাকসেনারা আলীশ্বর গ্রামে ঢুকে সিএন্ডবি রােডের পশ্চিম পাশের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং স্কুলের পেছনের বাড়ি থেকে দুজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে ধরে এনে স্কুলের সামনে গুলি করে হত্যা করে। তারা হলেন- হরেন্দ্রচন্দ্র সিংহ (পিতা মাধবচন্দ্র সিংহ) ও সুধীর কুমার সিংহ (পিতা স্বামিনী কুমার সিংহ)। পাকসেনাদের আলীশ্বর গ্রামে আসার খবর শুনে পূর্বেই গ্রামবাসীদের অনেকে গ্রাম ছেড়ে ডাকাতিয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে আশ্রয় নেয়। অবশিষ্ট যারা গ্রামে ছিল তাদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। শুধু আলীশ্বর নয়, বাগমারা, কুহুলকুচা, ফতেপুর, বরইয়া, জয়নগর, কাকসার, শালিচৌ ও জগৎপুর গ্রামসহ আশপাশের ১০টির মতাে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে পাকসেনারা অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট করে এবং ৫০ জনের অধিক সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। [ইমন সালাউদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!