আলী আকবর খান
আলী আকবর খান (১৯২২-২০০৯) আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়ােজন, অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা পালনকারী। জর্জ হ্যারিসন (১৯৪৩-২০১২), রবি শংকর (১৯২০-২০১২), বব ডিলন (জন্ম ১৯৪১), রিঙ্গো স্টার (জন্ম ১৯৪০) প্রমুখের সঙ্গে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অংশ নিয়ে সুরস্রষ্টা ও সরােদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খান সারা বিশ্বের সংবেদনশীল মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি মর্মস্পর্শী আবেদন তৈরিতে সক্ষম হন। তাঁর এ অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ সুরসম্রাট Friends of Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রাপ্ত হন।
আলী আকবর খান ১৯২২ সালের ১৪ই এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীতসাধক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত সঙ্গীতস্রষ্টা আলাউদ্দিন খাঁ (১৮৬২-১৯৭২)। শিশু আলী আকবর খান বেড়ে ওঠেন তাঁর পিতা ও পরিবারের সঙ্গে ভারতের মধ্য প্রদেশের মইহারে। পিতা আলাউদ্দিন খানের কাছ থেকে অল্প বয়স থেকে তিনি সঙ্গীতের তালিম নেয়া শুরু করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুরে এসে কিছুদিন তিনি তাঁর পিতৃব্য ফকির আফতাবউদ্দিনের কাছেও সঙ্গীতের শিক্ষা নেন। ওস্তাদ আলী আকবর খানের হাতে অনেক রাগের সৃষ্টি হয়। তিনি প্রথমে কলকাতায়, পরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও সুইজারল্যান্ডের বাসেলে সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও, ভারতের বিভিন্ন শহর এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। পণ্ডিত রবি শংকরের সঙ্গে তিনি অনেকবার সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সত্যজিৎ রায়-সহ ভারতীয় অনেক পরিচালকের চলচিত্রের জন্য তিনি সঙ্গীত রচনা করেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় করার পেছনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁকে সঙ্গীতবােদ্ধারা ‘the greatest musician in the world’ বলে মনে করেন। ভারতের পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হয়েছেন।
৭১-এর মার্চ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর নির্মম গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে লাখলাখ মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সারা বিশ্বে এ ঘটনা এক নিষ্ঠুর মানবিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী সকল মানুষ, বিশেষ করে বাংলাভাষীদের তা সাংঘাতিকভাবে মর্মাহত করে। এ-রকম মানুষদের একজন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ও সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শংকর। রবি শংকর ভারতের বেনারসে জন্মগ্রহণ করলেও তার পৈতৃক বাড়ি ছিল পূর্ব বাংলায়। তাঁর পিতা শ্যাম শংকর চৌধুরী বাংলাদেশের আলাে-বাতাসে বড় হন। যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাঙালি রবি শংকর বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মমতার বিরুদ্ধে ৭১ সালে কিছু করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি তাঁর বন্ধু জনপ্রিয় বিটলস শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে যােগাযােগ করে তার সাহায্য চান। হ্যারিসনের সহায়তা ও নেতৃত্বে ১লা আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর আয়ােজন করেন। এ আয়ােজনে দুই ধরনের সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। একটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও অন্যটি ছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীত। ভারতীয় ধারার সঙ্গীতে রবি শংকরের সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেন আলী আকবর খান। শংকর| খান যুগল দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। তাদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা (১৯২০-২০০০) ও তম্বুরায় কমলা চক্রবর্তী (জন্ম ১৯২৮)। কেবল এদিনের পরিবেশনা নয়, আলী আকবর খান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এ কনসার্টের পূর্বে নিজে এককভাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। ২৮শে মে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কিলিতে অনুষ্ঠিত কনসার্টের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। আলী আকবর খানের এ কনসার্টের আলাদা গুরুত্ব ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে আয়ােজিত এ অনুষ্ঠান বাংলাদেশের পক্ষে ব্যক্তি ও সাংগঠনিক পর্যায়ে নানা ধরনের কার্যক্রমকে অনুপ্রাণিত করে। আলী আকবর খান নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় ও আলােচনার মাধ্যমেও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অবদান রাখেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ ওস্তাদ আলী আকবর খানকে Friends of Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রদান করে। ৮৮ বছর বয়সে এ সুরসম্রাট ও বাংলাদেশের বন্ধু ২০০৯ সালের ১৮ই জুন ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৮ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক। তার ৬ সন্তান ও ১ নাতি সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। [জালাল আহমেদ]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়ােদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা ২০১০; A M A Muhit, American Response to Bangladesh Liberation War, UPL, Dhaka 1996
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড