You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে আলীকদম উপজেলা (বান্দরবান) - সংগ্রামের নোটবুক

আলীকদম উপজেলা

আলীকদম উপজেলা (বান্দরবান) বান্দরবান জেলার পার্বত্য অঞ্চলের কাছে সমভূমি-প্রধান হলেও এখানে কিছু পাহাড় রয়েছে। থাইংকিয়াং তাং, রমংরাং তাং ও সারা তাং এ উপজেলার উল্লেখযােগ্য পাহাড়। ১৯৭১ সালে এ উপজেলা লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৬ সালে এ থানা গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর আলীকদম থানার সর্বস্তরের মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর বর্বর আক্রমণ, গণহত্যা এবং গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়া ইত্যাদি কারণে আলীকদমের মানুষ আরাে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘােষিত স্বাধীনতার কথা শুনে ছাত্র, তরুণ ও রাজনৈতিক কর্মীরা উদ্বুদ্ধ হয়। এরপর আলীকদমের আওয়ামী লীগ সভাপতি বাদশা মিয়া, আনােয়ার হােসেন চৌধুরী, আলীম উদ্দিন, ঞো হ্রা অং মারমা, উচা মং মারমা, কালা মিয়া, সৈয়দুর রহমানসহ অন্যরা আলীকদম বাজারে একটি সভা করেন। এ সভা থেকে আলীকদমে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আলীকদমের পাহাড়ি এলাকায় অনেকে গােপনে কাজ শুরু করেন। এপ্রিল মাসে স্থানীয় ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে আলীকদম কেন্দ্রীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি বৈঠক হয়। এরপর এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আবদুস ছােবহান (ফুলতলা, বাটাখালী, চকরিয়া) মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। কালা মিয়া মেম্বারও (আনসারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) প্রশিক্ষণ দেন। এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন- ঞো হ্র অং মারমা (পিতা কোলারী মারমা), নিত্যানন্দ দে (পিতা রসিক চন্দ্র দে), মাে. নুরুল আলম (পিতা মােহাম্মদ হােসেন), আমিনুল হক (পিতা হােসেন আহমেদ), ছিব্বির আহম্মদ, দিদারুল আলম, ডা. অং ক্যজ মারমা, রনজিত কুমার শীল (পিতা বিভূতি শীল), সৈয়দুর রহমান (পিতা আবদুস ছােবহান), রফিক আহমদ চৌধুরী (পিতা আনােয়ার হােসেন চৌধুরী), মাে. আমিন প্রমুখ। রাজাকারদের প্রতিহত করার বিভিন্ন কৌশল সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দেন তেজেন্দ্র লাল দে (পিতা প্রাণকৃষ্ণ দে), সুধাংশু শীল (পিতা দুর্গা চরণ শীল), ধনঞ্জয়। ধর এবং আবু তালেব।
প্রথমদিকে আলীকদমে প্রশিক্ষণ নিলেও পরে অনেক মুক্তিযােদ্ধা পুটিবিলা ও চকরিয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পুটিবিলা ক্যাম্পের কমান্ডার ও সংগঠক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হামিদ (বমুবিলছড়ি, লামা), মােহাম্মদ জয়নাল (কাকারা, চকরিয়া), মাে. নজির আহম্মদ (ভাইস চেয়ারম্যান, সুরাজপুর) প্রমুখ। চকরিয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন তাহের উদ্দিন (ডুলহাজারা, চকরিয়া)। অনেকে ভারতে গিয়েও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ভারতে যারা প্রশিক্ষণ নেন, তাঁরা হলেন- ধনঞ্জয় ধর (পিতা দীনবন্ধু ধর, ছাবের মিয়া পাড়া), কান্ত রায় ত্রিপুরা (পিতা পূর্ণ চন্দ্র ত্রিপুরা, বাবুপাড়া), উচা মং মারমা, সুই চে মং মারমা (খানসামা পাড়া), সুবেদার কালাম প্রমুখ।
আলীকদমে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রাথমিক কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ হয়, সেসবের সংগঠক বা কমান্ডার ছিলেন ধনঞ্জয় ধর। সহকারী সংগঠক ছিলেন পুলিশ সদস্য সুধাংশু শীল (পিতা দুর্গা চরণ শীল), নিত্যানন্দ দে (পিতা রসিক চন্দ্র দে, বাজারপাড়া), আজিজুল ইসলাম মেম্বর (আলীকদম), যুব সংগঠক মাে. রফিক আহমদ চৌধুরী (পিতা আনােয়ার হােসেন চৌধুরী, চেয়ারম্যান পাড়া), মাে. আমিন (আলীকদম) প্রমুখ।
আলীকদম উপজেলায় স্থানীয় বিশেষ কোনাে বাহিনী ছিল না। তবে লামার হামিদ বাহিনী, আবদুস ছােবহানের রামু বাহিনী এবং পুটিবিলা বাহিনী আলীকদমে সক্রিয় ছিল। আলীকদমে আনােয়ার হােসেন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযােদ্ধা দলের শক্তিশালী অবস্থান ছিল।
পাকবাহিনীর দোসরদের প্রতিরােধের জন্য ১৬ই এপ্রিল আলীকদম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনােয়ার হােসেন চৌধুরীর আহ্বানে আলীকদম বাজারে একটি সভা হয়। এ সভায় পার্শ্ববর্তী লামা থেকে যেসব রাজাকার আলীকদমে এসে লুটপাট ও নির্যাতন চালাচ্ছিল তাদের এবং তাদের সঙ্গে আলীকদমের যেসব দালাল যােগ দিয়েছিল, তাদের মােকাবেলার কৌশল নিয়ে আলােচনা হয়। এদের প্রতিহত করার জন্য যুবকদের মধ্য থেকে ১২-১৩ জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ঞো হ্রা অং মারমা (রাজার পাড়া), আব্দুল্লাহ, মাে. আবুল কাশেম, কালা মিয়া, সৈয়দুর রহমান, এস্তাক মাস্টার, দুদু মিয়া, পাইং গ্যা মারমা ফরেস্টার, বিমল চাকমা রেঞ্জার, আলী হােসেন, ফজল করিম, এফআইডিসি সুপার, মােহাম্মদ হােসেন হেডম্যান, এডিলা চাকমা (পানবাজার) প্রমুখ। এ সভায় চেয়ারম্যান আনােয়ার হােসেন কয়েকজনের কাছ থেকে ৬ মাসের জন্য বন্দুক ধার নেন। এসব বন্দুক রাজাকার ও দালালদের প্রতিরােধে ব্যবহার করা হয়। আলীকদম বাজারের পাশে ডাকবাংলােতে মুক্তিযােদ্ধা শুধাংশু শীল এবং আবু তালেবের সঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের একটি সভা হয়। এ সভায় রাজাকারদের প্রতিহত করার কৌশলসহ অন্যান্য বিষয়ে আলােচনা করা হয়।
আলীকদমে পাকসেনাদের অনুপ্রবেশ ঘটে একাধিকবার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবি মেজর জামান দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিশেষ করে চকরিয়া, লামা, আলীকদম, রামু, কক্সবাজার এলাকায় হানাদার বাহিনীর কর্তৃত্বে ছিল। আলীকদমে পাকবাহিনীর কোনাে ক্যাম্প স্থাপিত হয়নি। তবে নিকটবর্তী দুইখ্যা-সুইখ্যা পাহাড়ে পাকসেনা ও পুরিক্ষা বাহিনীর (বর্মিদের একটি বাহিনী, এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনাদের সহায়তা করে) ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পাকসেনা ও পুরিক্ষ্যা বাহিনী আলীকদম থেকে লােক সংগ্রহ করে রাজাকার বাহিনী। গঠন করে। মেজর জামানের নেতৃত্বে আলীকদমে পাকবাহিনী টহলে আসত।
আলীকদমে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির অনেক সক্রিয় সদস্য ছিল। বান্দরবানের বােমাং রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী এমপিএ মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী ভূমিকা পালন করে। আলীকদমে পাকবাহিনীর সহযােগী হিসেবে ১৫ সদস্যের শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ও সচিব ছিল যথাক্রমে ছাবের মিয়া (ছাবের মিয়া পাড়া) এবং ছিদ্দিক আহমদ কেরানী (ছাবের মিয়া পাড়া)। সদস্য ছিল- আহমদ হােসেন (রাজাকার কমান্ডার, আলীকদম, বর্তমান মংলাপাড়া), ছমি উল্লাহ (ছাবের মিয়া পাড়া), মংচি হেডম্যান (চৈক্ষ্যং), বজল কবির (আলীকদম), চাতুই হেডম্যান (বাজার পাড়া), ধুমং মাস্টার (মংলাপাড়া), অং চালা মারমা (বাজার পাড়া), বশির আহমেদ ডিপু (চৈক্ষ্যং), মৌওলানা ইদ্রিস (পানবাজার), গুরা মিয়া (পানবাজার) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা আলীকদমে নিরীহ মানুষকে হত্যা, নারীধর্ষণ, নির্যাতন, অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগসহ নানা কর্মকাণ্ড চালায়। রাজাকাররা পাকসেনাদের সঙ্গে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের নির্যাতন ও হত্যা করত।
রাজাকার কমান্ডার আহমদ হােসেন নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ ও অত্যাচারের মাধ্যমে আলীকদমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার ভয়ে সাধারণ মানুষ নদীপথে মালামাল নিয়ে চলাচল করত না। তার বাহিনী সাধারণ মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন ও তাদের ওপর নানারকম নির্যাতন চালাত।
আলীকদমে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে অনেক নারী নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিহত হন। রাজাকাররা অনেকের বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। তারা কালী মহাজনের বাড়ি থেকে নগদ অর্থ ও অলংকার এবং গােলা থেকে ৩০০ আরি ধান নিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযােদ্ধা ঞো হ্র অং মারমা, বিমল চাকমা, আহমদ হােসেন, এফআইডিসি সুপার, অং ক্যজ রাখাইন প্রমুখ গুলি করলে তারা পালিয়ে যায়।
ডা. বিনােদ বিহারী ধর বান্দরবানের একজন প্রগতিশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। রাজাকাররা তাঁর বাড়ি লুট এবং বাড়ির মেয়েদের নির্যাতনের চেষ্টা করে। মুক্তিযােদ্ধারা খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তাঁর ধন-সম্পদ ও মেয়েদের রক্ষা করেন। এক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধা ঞো হ্রা অং মারমা, বিমল চাকমা, আহমদ হােসেন, এডিলা চাকমা, মাে. আবুল কাশেম, অং ক্যজ রাখাইন, কালা মিয়া প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রাজাকাররা বাছাইয়া মহাজন (তনচঙ্গ্যা) এবং মং পুই মারমা (মহাজন)-র বাড়ি লুট করে। তারা এখান থেকে নারী-পুরুষদের নির্যাতন শেষে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়।
আলীকদম উপজেলার নিকটবর্তী দুইখ্যা-সুইখ্যা পাহাড়চূড়ায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। এখানে মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লােকজনদের ধরে নিয়ে নির্যাতন এবং বন্দি করে রাখা হতাে। দুইখ্যা-সুইখ্যা পাহাড়ে অবস্থিত বর্মি পুরিক্ষা বাহিনীর ক্যাম্প একটি ভয়ঙ্কর স্থান ছিল। আলীকদমের পশ্চিম পাশে মাতামুহুরী নদীর পাড়ে রাজাকার বাহিনীর অফিস ছিল। এটিকেও নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করা হতাে।
২১শে এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল আলীকদম বৌদ্ধ বিহারের পাশে ৩ সদস্যের একটি রাজাকার দলের ওপর আক্রমণ করে। এতে একজন রাজাকার আহত হয়। অন্যরা আহত রাজাকারকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
২৮শে এপ্রিল রাজাকাররা স্থানীয় হাসপাতালের ডা. বিনােদ বিহারী ধরের বাড়িতে লুট করতে যায়। ২০-২৫ জন। রাজাকারের দল ঘরের দরজা ভাঙ্গারত অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হলে ভয়ে পালিয়ে যায়।
১লা মে ৬ জন মুক্তিযােদ্ধা যথা ঞো হ্র অং মারমা, আব্দুল্লাহ, বিমল চাকমা, এফআইডিসি সুপার, অং ক্যজ মারমা, সুংতং ম্রো একটি অপারেশন থেকে ফেরার পথে ডা. বিনােদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন।
আলীকদম বাজারের কালী মহাজনের বাড়িতে রাজাকাররা লুটপাট করতে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিহত করতে গুলি ছােড়েন। ফলে রাজাকাররা পালিয়ে যায়।
৫ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা লামা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার আবু তাহের। মুক্তিযােদ্ধারা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ভােরে এ আক্রমণ পরিচালনা করেন। আধ ঘণ্টা দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। ৩ জন রাজাকার এ-যুদ্ধে আহত হয়। পরে মুক্তিযােদ্ধারা আলীকদমে ফিরে আসেন। ১৪ই ডিসেম্বর আলীকদম হানাদারমুক্ত হয়।
আলীকদম উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধা হলেন লা ফ্রে স্রো (পিতা মেনরুই ম্রো, মাতা চামলে ম্রো, মেরেঞ্জা, ছােটবতী)।
আলীকদম উপজেলায় মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে কিছু পাড়ার নামকরণ করা হয়েছে। আলীকদম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মুক্তিযােদ্ধা আনােয়ার হােসেন চৌধুরী এবং মুক্তিযােদ্ধা আলীম উদ্দিনের স্মৃতি রক্ষার্থে যথাক্রমে চেয়ারম্যান পাড়া এবং আলীম উদ্দিন পাড়া নামে দুটি পাড়ার নামকরণ করা হয়েছে। [জগন্নাথ বড়য়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড