আলশামস বাহিনী
আলশামস বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগী হিসেবে গঠিত প্যারামিলিশিয়া বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধবিরােধী যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে এটি গঠিত হয়। এ বাহিনীর দক্ষতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে এর সদস্যদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতাে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের প্রাক্কালে এ বাহিনী এদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মূল নায়ক হিসেবে কাজ করে।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গােলাম আযম দলীয় পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম-এর মাধ্যমে ‘দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরােধ ও যুদ্ধের ডাক দিয়ে প্রথমে রাজাকার বাহিনী গঠন করে এবং এ বাহিনীর আমীরের পদ গ্রহণ করে। এ-সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের শীর্ষনেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং ছাত্র সংঘের অপর নেতা ও রাজাকার বাহিনীর সমন্বয়কারী আবদুল কাদের মােল্লার নেতৃত্বে আলশামস ও আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (২০০১-২০০৬ সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী; জামায়াতে ইসলামীর আমীর; মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে ২০১৬ সালের ১০ই মে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর) আলশামস ও আলবদর বাহিনীর প্রধান এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ (২০০১-২০০৬ সময়ে বিএনপিজামায়াত জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী; জামায়াতে ইসলামীর সেক্রটারি জেনারেল; মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের ২১শে নভেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর) ঢাকা মহানগরের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিল। একই সঙ্গে তারা সমগ্র দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী প্রচারণা এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করে সশস্ত্র তৎপরতা চালায়। ইসলামী ছাত্র সংঘের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি আবদুল কাদের মােল্লা (মিরপুরের কসাই’ হিসেবে কুখ্যাত; জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল; মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর) আলশামস ও আলবদর বাহিনীর হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ ও তাঁদের ওপর নানাভাবে টর্চারের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল। আলশামস ও আলবদর বাহিনীর কর্মকাণ্ড ছিল সম্পূরক। আলশামস বাহিনী গঠন প্রসঙ্গে ইরানি বংশােদ্ভূত লেখক Seyed Vali Reza Nasr তার The Vanguard of the Islamic Revolution : The Jamma’ati Islami of Pakistan গ্রন্থে উল্লেখ করেন, The campaign confirmed the Islami Jamiat-e-e Talabe’s (IJT) place in national politics especially in May 1971, when the IJT (Islami Jamiat-e-e Talabe’s – Chatro Sango) joined the army’s urgency campaign in East Pakistan. With the help of the army the IJT organized two paramilitary units, called al-Badr and al-Shams, to fight the Bengali guerrillas. Most of al-Badr consisted of IJT members, who also galvanized support for the operation among the Mujahir community settled in East Pakistan. Mutiur Rahman Nizami, the IJT’s nazim-1 a’la (supreme head or organizer) at the time, organized al-Badr and alShams from Dhaka University.’
আলশামস বাহিনীর লক্ষ্য ছিল জামায়াতে ইসলামের নীতি অনুসরণ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করা। এ বাহিনী আওয়ামী লীগকে ভারতীয় চর’ এবং পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করে এ সংগঠন ও মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণা করে। এ ধরনের ধর্মভিত্তিক সংকীর্ণ নীতির বশবর্তী হয়ে আলশামস বাহিনী মানবতাবিরােধী বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়। অপরদিকে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মানবতাবিরােধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে সহযােগিতার পাশাপাশি নিজেরাও ইতিহাসের বর্বরতম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরােধীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় মানবতাবিরােধী অপরাধ যেমন গণহত্যা, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা, দাসত্বে। বাধ্য করা, দেশত্যাগে বাধ্য করা, বন্দি, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ ইত্যাদি সংঘটিত করে।
মুক্তিযােদ্ধারা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন আলবদর, আলশামস বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন স্তরের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে। সে অনুযায়ী তারা শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ডাক্তার প্রকৌশলীসহ দেশের বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে যখন এ বাহিনী তাদের অফিস ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন তাদের অফিস থেকে বস্তাভরা মানুষের চোখ উদ্ধার করা হয়। হত্যার আগে এ নরপশুরা মানুষের চোখ উপড়ে ফেলত। হত্যাকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা মিরপুর, মােহাম্মদপুর, রায়ের বাজারসহ বিভিন্ন নির্জন এলাকাকে বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরপর ঢাকার বিভিন্ন বধ্যভূমিতে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা শতশত লাশ ভাসতে দেখেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড