You dont have javascript enabled! Please enable it!

আলমডাঙ্গা উপজেলা

আলমডাঙ্গা উপজেলা (চুয়াডাঙ্গা) ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন এখানকার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ নেতৃত্বকে আন্দোলিত করে। তাদের একজন কাজী কামাল (৭১-এ বিএলএফ কমান্ডার) তরুণদের নিয়ে ওয়াপদা ব্রিকফিল্ডে রাজনৈতিক ক্লাস নিতেন এবং ৬-দফা ও ১১-দফা বিষয়ে আলােচনা করতেন। তাদের উদ্যোগে ‘গ্রামে ফিরে চলাে’ নামে একটি নাট্য সংস্থার জন্ম হয়। এছাড়া ডা. সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে আলমডাঙ্গায় ‘তাজ লাইব্রেরি ও হাটবােয়ালিয়ায়’ ‘উদয়ন তরুণ সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব উদ্যোগ অত্র এলাকার মানুষের মনে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও স্বাধীনতার আকাক্ষা জাগ্রত করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গাবাসী বিপুল ভােটে ব্যারিস্টার আফজালুর রশীদ বাদলকে জাতীয় পরিষদে এবং ডা. আসহাবুল হক (হ্যাবা ডাক্তার)-কে প্রাদেশিক পরিষদে জয়যুক্ত করে। সারা দেশেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ ইয়াহিয়াভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষিত হলে সমগ্র দেশের ন্যায় আলমডাঙ্গার সর্বস্তরের মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ২রা মার্চ অসহযােগ আন্দোলন-এর ডাক দিলে আলমডাঙ্গাবাসী সর্বাত্মকভাবে তাতে অংশগ্রহণ করে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আলমডাঙ্গায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের সভাপতি ছিলেন ডা. আসহাবুল হক এমপি, সহ-সভাপতি সাফায়েত-উল-ইসলাম ও ডা. শমসের আলী, সাধারণ সম্পাদক ডা. সাহাবুদ্দীন আহম্মদ সাবু, কোষাধ্যক্ষ সত্যনারায়ণ মােদি, পর্যবেক্ষক ও বাজার নিয়ন্ত্রক (ফুড ইন্সপেক্টর) মাে. আব্দুল জলিল ও মহম্মদ লতাপত হােসেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সম্পাদক দাউদ হােসেন জোয়ার্দার (আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি) ও কাজী কামাল। পরিষদের অফিস ছিল আলমডাঙ্গা কলেজের একটি কক্ষে, যা কুষ্টিয়া প্রতিরােধ যুদ্ধের সময় কন্ট্রোল রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশি একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। আলমডাঙ্গার জনপ্রশাসন সংগ্রাম পরিষদ তথা জনতার সঙ্গে যােগ দেয়। ভাংবাড়ীয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেফাজ উদ্দীন বিশ্বাস সর্বপ্রথম সিও (ডেভলপমেন্ট)-এর নিকট তার পদত্যাগ পত্র দাখিল করেন। পরবর্তীতে তারই নেতৃত্বে আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গার অনেক চেয়ারম্যান ও মেম্বার অসহযােগ আন্দলনে শরিক হয়ে পদত্যাগ করেন। হাটবােয়ালিয়া হাইস্কুলের ছাত্রশিক্ষকগণ আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি জঙ্গি মিছিল নিয়ে পার্শ্ববর্তী গাংনী থানার ষােলটাকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইছাহক আলীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এভাবেই আলমডাঙ্গা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
২৫শে মার্চের কালাে রাত্রির পর ২৬শে মার্চ আলমডাঙ্গার সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ, চুয়াডাঙ্গার নেতৃবৃন্দ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং চুয়াডাঙ্গার উর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দ ইপিআর-এর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর বাসায় এক জরুরি সভায় মিলিত হন। সভায় মেজর আবু ওসমান ব্যারিস্টার আফজালুর রশীদ এমএনএ, ডা. আসহাবুল হক এমপিএ ও এডভােকেট ইউনুস আলী এমপিএ-র উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার পক্ষে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং নিজ বাসভবন ও চুয়াডাঙ্গাস্থ ইউনিট হেডকোয়ার্টার্সে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি তাঁর ভাষণে সকল কর্তব্যরত ও অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশকে কুষ্টিয়ায় অবস্থানরত পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। এতদুদ্দেশ্যে চুয়াডাঙ্গা শ্ৰীমন্ত টাউন হল ও আলমডাঙ্গা কলেজে প্রতিরােধ যুদ্ধ কন্ট্রোল রুম খােলা হয়। আলমডাঙ্গা থানার কতিপয় আনসার সদস্য আসমানখালী বাজার ও মুন্সিগঞ্জের মদনবাবুর মােড়ে একত্রিত হয়ে, কেউ-কেউ শ্ৰীমন্ত টাউন হল থেকে, কেউ-বা আলমডাঙ্গা থানা কাউন্সিল মাঠ থেকে সশস্ত্র অবস্থায় প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য কুষ্টিয়া যায়। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে জয়লাভ করে মুক্তিকামী জনতা আনসার ও ইপিআর সদস্যদের নিয়ে যশােরের বিষয়খালীতে ডিফেন্স নিয়ে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়াকে পক্ষকাল ব্যাপী মুক্ত অঞ্চল হিসেবে দখলে রাখে। ঐ সময় কুষ্টিয়ার ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এমএনএ আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে চুয়াডাঙ্গায় যাত্রাবিরতি করেন। তাঁরা মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও নির্বাচিত তিনজন জনপ্রতিনিধিসহ অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক আলােচনা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী করার ঘােষণা দেয়া হয় এবং নির্মীয়মাণ সদর হাসপাতালে তার কার্যালয় হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এখানেই বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পূর্বঘােষিত অস্থায়ী রাজধানী চুয়াডাঙ্গাতে হওয়ার কথা থাকলেও সংবাদটি জানাজানি হয়ে গেলে পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় বােম্বিং করে। এর ফলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগর (বৈদ্যনাথতলা)-এ অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে চুয়াডাঙ্গার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ব্যারিস্টার আফজালুর রশীদ এমএনএ, সাফায়েত-উল-ইসলাম, ডা. সাহাবুদ্দীন আহম্মদ সাবু, কাজী কামাল, আনু মিয়াসহ আলমডাঙ্গার প্রায় ৫০-৬০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁদের প্রায় সকলেই অনুষ্ঠান শেষে ভারতে চলে যান।
১৫ই এপ্রিল বােম্বিং করার পর চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার সকল অঞ্চল পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। আলমডাঙ্গার মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার অনেকেই ভারতে গিয়ে বিএলএফ ও ২এফএফ গ্রুপের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বিএলএফ গ্রুপে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে কাজী কামাল, মােজাহারুল ইসলাম ঝন্টু (বটিয়াপাড়া), আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রাজা মিয়া (কায়েতপাড়া) প্রমুখ ছিলেন। পরে এঁরা আলমডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ ও সাহসী মুক্তিযােদ্ধা তৈরি করেন। আলমডাঙ্গা থানার উল্লেখযােগ্য কয়েকটি ট্রেনিং সেন্টার হলাে- বটিয়াপাড়া স্কুলমাঠ, কানাইনগর কুঁঠি, নদীবেষ্টিত বন্দর গ্রাম, কুমার নদীর উৎসমুখে কেশবনগর চর, বড়বােয়ালিয়ার ভিটেপালা, কেশবপুরের মরা নদীর ড্যামচর, ওসমানপুরের সাইর বাগান সংলগ্ন কুমার নদের তীরের মাঠ, আবুরীর হাট (মিরপুর), শ্রীরামপুর ক্যানাল কালভার্ট মাঠ, ডম্বলপুর মাঠ, বলরামপুর বটতলা, রামদিয়া হিলট্যাক্স পাড়া, রামদিয়া বাদল রশিদের বৈঠক খানা, ঘােলদাড়ী কেরুর কুঁঠির মাঠ, নারানকান্দি চরের মাঠ প্রভৃতি। বটিয়াপাড়া স্কুলমাঠে প্রশিক্ষণকালে আবিদ হােসেন (পিতা আজিবর রহমান মন্ডল) নামে একজন মুক্তিযােদ্ধা অসতর্কতাবশত নিজেদের গুলিতে শহীদ হন। একই সঙ্গে আহত হন তার সহােদর মকবুল হােসেন।
আলমডাঙ্গা উপজেলায় উপযুক্ত নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন কেরন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন: বিএলএফ- কাজী কামাল (আলমডাঙ্গা পৌরসভা), মােজাহারুল ইসলাম ঝন্টু (বটিয়াপাড়া, বর্তমান চুয়াডাঙ্গা এক্সেঞ্জপাড়া) ও আব্দুর রাজ্জাক রাজা মিয়া (কায়েতপাড়া) এবং এফএফ- আব্দুল হান্নান রতন (স্টেশনপাড়া), হাফিজুর রহমান জোয়ার্দার (বটিয়াপাড়া), আব্দার রহমান জোয়ার্দার (শ্রীপুর, বর্তমান আলমডাঙ্গা কলেজপাড়া), শফিউর রহমান জোয়ার্দার (সুলতানকালিদাসপুর), মাে. জামাল উদ্দীন (টেকপাড়া), খাইরুল আনাম (গড়চাপড়া), মুন্সি এনামুল হক (মােচাইনগর), মনিরুজ্জামান ভুলু (হাটবােয়ালিয়া), মতিয়ার রহমান মন্টু (কয়রাডাঙ্গা), শেখ ওমর ফারুক (হারদী), মাে.শাহার আলী (নাগদা), মাে. নজির উদ্দীন (মাজহাট), রেজাউল হক (কয়রাডাঙ্গা), আব্দুস শুকুর বাঙালী (কুলচারা), লুৎফর রহমান (পাইকপাড়া) ও মােল্লা আবুল হােসেন নান্নু (স্টেশনপাড়া, আলমডাঙ্গা পৌরসভা; পরে শহীদ)।
কুষ্টিয়া ও বিষয়খালীতে প্রতিরােধ যুদ্ধের পর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে ছিল। চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা বিভিন্ন সূত্রে জানাজানি হলে ১৫ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থাপনায় বােম্বিং করে এবং অত্র এলাকা তাদের দখলে চলে যায়। এরপরই পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মী ও স্থানীয় বিহারিদের প্ররােচনায় ১২ই মে আলমডাঙ্গা শহরে প্রবেশ করে ৬ জন আওয়ামী লীগ সমর্থককে ধরে নিয়ে হাটবােয়ালিয়া ফেরিঘাটের পূর্বতীরে গুলি করে হত্যা করে। তারপর তারা আলমডাঙ্গায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে জেহালা ও হাটবােয়ালিয়ায়ও ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
পাকবাহিনী উপজেলায় প্রবেশ করার পর স্বাধীনতাবিরােধীরা প্রতিটি ইউনিয়নে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে তাদের সহায়তা করে। ইউনিয়ন-ভিত্তিক তাদের পরিচয়: ভাংবাড়ীয়া ইউনিয়ন জাফর সাদেক (বগাদী, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), ডা. আবেদ আলী, আব্দুল মান্নান ওরফে গার্ড সাহেব, আবু তাহের, বুদু মিয়া ও জলিল রিফিউজি। এখানকার পেশাদার রাজাকাররা হলাে ভাংবাড়ীয়ার হানেফ, আব্দুর রহমান, আয়ুব আলী, বরকত আলী, ছানােয়ার জোয়ার্দার, আবু ছদ্দিন, হাটুভাঙ্গার লাইলদ্দিন, আকালি, লােকমান, রবজেল সাহেব, নগরবােয়ালিয়ার খবির উদ্দীন, কেরামত আলী ওরফে কেরু শাহ, আব্দুর রাজ্জাক ও বজলু। হাটবােয়ালিয়ার হায়দার বেপারীর আড়ঘর ছিল এদের অফিস; হারদী ইউনিয়ন হারদীর আনিসুজ্জামান খান (মুসলিম লীগ নেতা), শফিউজ্জামান খান, আনসার আলী, আক্কাস আলী, কোরবান আলী, তেলা; কুমারী ইউনিয়ন- যাদবপুরের মাে. আবুল হােসেন (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও কুমারী ইউনিয়ন বাের্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট, পরে নিজের মুক্তিযােদ্ধা সন্তানের হাতে নিহত), আকবর হাফেজ, নুরু চেয়ারম্যান, আজগর আলী, হায়াত আলী, ইস্রাফিল, নজরুল, দেলােয়ার, রবিউল, সেকেন্দার; কালিদাসপুর ইউনিয়ন কালিদাসপুরের আব্দুল মালেক (শান্তি কমিটির সাবেক সভাপতি), আফছার আলী বিশ্বাস (পরবর্তী সভাপতি), ইছারত মিয়া (সহ-সভাপতি), রাজাকার সামসদ্দিন, আলমগীর বিশ্বাস, খােকন, আজম আলী, আক্কাস আলী, ফজলু, সওম, আব্দুর রাজ্জাক, মােজাম আলী, রায়হান প্রমুখ; ডাউকি ইউনিয়ন আহমদ আলী বােকড়া (ডাউকি, শান্তি কমিটির সদস্য ও অত্যাচারী), বিশারত ডাক্তার, মােস্তফা; বেলগাছি ইউনিয়ন- ফরিদপুরের সামসুদ্দিন বিশ্বাস (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), সাকের জোয়ার্দার, নুর বকস্ মন্ডল, নেংটি মিয়া, রাজ মালিথা, মুক্তার বিশ্বাস, রাজাকার নাসির উদ্দীন, রেজাউল, আজির বকস; জামজামি ইউনিয়ন- মকছেদ চৌধুরী (ভদুয়া, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), মহাতাজ মিয়া, নুরু বিশ্বাস, আয়ুব হােসেন, রাজাকার জিন্নাত; খাসকররা ইউনিয়ন ইছাহাক আলী বিশ্বাস (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), রাজাকার মসলেম জোয়ার্দার, নাজিম, দুলু লস্কর, মনা; আইলহাঁস ইউনিয়ন মফের বিশ্বাস (শান্তি কমিটির সদস্য), মঙ্গল বিশ্বাস, মওলা বকস, আবুল মিয়া, সাজদার বিশ্বাস, আবুল মিয়া; নাগদহ ইউনিয়ন- আবুল হােসেন (বলেশ্বরপুর, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), রাজাকার আমােদ আলী, আবুল কাশেম, মােবারক বিশ্বাস, মসলেম আলী, আনছার বিশ্বাস, সমির মুন্সি, মসলেম বিশ্বাস; জেহালা ইউনিয়ন- এডভােকেট গােলাম রহমান (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), আবুল হােসেন, আব্দুল লতিফ, জাহান আলী মাস্টার, রােয়াকুলির আবু ডাক্তার, আলি রেজা, বুলবুল আহমদ, মাওলানা আব্দুল হক, কালুব্বারি, ইয়াকুব আলী, রাজাকার নেপাল আলী (গড়চাপড়া, কমান্ডার), তােফাজ্জেল হােসেন পালিত, নুর মহম্মদ, হারু খা, ইয়াকুব আলী, জেনারুল; খাদিমপুর ইউনিয়ন বাদল; চিলা ইউনিয়ন- খােদা বকস বিশ্বাস (রুইতনপুর, খাদিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির সভাপতি), রাজাকার নুরু বাবু, বাদল, জয়নাল, কিয়াম উদ্দীন, নজির, মুনসুর ভগভগি, মােয়াজ্জেম, ফকির মাস্টার, বাবুর আলী প্রমুখ (এরা খুবই দুর্ধর্ষ ছিল); গাংনী ইউনিয়ন মিয়া মুনসুর (বড়গাংনী, মুসলিম লীগ নেতা ও সাবেক এমএলএ), মােবারক মুন্সি, কালুব্বারী, সাবান আলী, তাছের, ছামেদ বেপারী, ভুলু মুন্সি, রবিল মুন্সি, আবিদাল, জামিল মিয়া (রাজাকারদের পরিচালক); আলমডাঙ্গা পৌরসভা আহম্মেদ আলী (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), ইউসুফ মিয়া (মুসলিম লীগের সাবেক এমএলএ), মফিজ উদ্দীন বিশ্বাস, আকুল মােল্লা, আনােয়ার বিহারী, রজব বিহারী, আবুল শাহ্ মােল্লা, ইছা মােল্লা, ডা. আব্দুল হামিদ, ছাদেক চেয়ারম্যান, ইব্রাহিম কসাই, আব্দুল মালেক, ইসারত মিয়া, শরিয়ত মিয়া; পেশাদার রাজাকারআবু ছদ্দিন, জসিম উদ্দীন গােপাল, সামসুল হক, রমজান আলী, নবিছদ্দীন, দাউদ আলী প্রমুখ; বাড়াদি ইউনিয়ন শাজাহান (পােলতাডাঙ্গা, শান্তি কমিটির সদস্য), রাজাকার তুষার, ঝড় ও মনি।
পাকবাহিনী ১২ই মে আলমডাঙ্গায় ক্যাম্প স্থাপন করার পর থেকেই হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযােগ শুরু করে। তারা লালব্রিজে ট্রেন থামিয়ে বেছে-বেছে যাত্রীদের হত্যা করত। যুবতীদের ধর্ষণ শেষে হত্যা করত। হত্যার স্থানটি আলমডাঙ্গা রেলব্রিজ বধ্যভূমি নামে পরিচিত। এখানে নিহতদের লাশ ব্রিজের পশ্চিম পাশে ওয়াপদা ব্রিকফিল্ডে নিয়ে কবর দিত। যুদ্ধের পর সহস্রাধিক মাথার খুলি ও হাড়গােড় এখান থেকে উদ্ধার করা হয়। তাই এ স্থানটি ওয়াপদা ব্রিকফিল্ড গণকবর হিসেবে পরিচিত। পাকসেনারা ৭ই ডিসেম্বর ব্রিজের উত্তর-পশ্চিম পাড়ে ওয়াপদা ভবনের একটি কক্ষে ১০-১২ জন যুবতীকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে আলমডাঙ্গা ত্যাগ করে। এ ঘটনা ওয়াপদা ভবন গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকসেনারা জেহালা ও হাটবােয়ালিয়া ক্যাম্প থেকে এসে রাজাকারদের সহায়তায় নাগদাহ-ঘােলদাড়ী বাজার, বারাদী, পােলতাডাঙ্গাসহ বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিসংযােগ, হত্যা ও নির্যাতন চালায়। মুন্সিগঞ্জ স্টেশনের উত্তর পাশে বহুলােককে হত্যা করে কবর দেয়। কবরের স্থানটি এখন মুন্সিগঞ্জ স্টেশন গণকবর নামে পরিচিত। পাকসেনারা হাটবােয়ালিয়ার মাড়ােয়ারি ব্যবসায়ী গােপাল বাবুর আড়বাড়ি ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। এর ফলে আড়তের পাট, গুড়, হলুদ, সরিষা, ছােলা, মশুরিসহ সকল মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
১৫ই সেপ্টেম্বর গাংনী গ্রামের ৫ জন সাধারণ লােক পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন। তারা হলেন- সানােয়ার হােসেন (পিতা ছবির মন্ডল), তাহাজ্জেল তারা (পিতা খােকাই মন্ডল), আমােদ আলী (পিতা জব্বার মন্ডল), খেশারত আলী (পিতা জব্বার মন্ডল), ভাদু (পিতা মতিলাল, হেমায়েতপুর, থানা গাংনী, জেলা মেহেরপুর)।
পােলতাডাঙ্গায় মুক্তিযােদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। পাকসেনারা এ খবর পেয়ে অক্টোবর মাসের শেষদিকে এখানকার মহির চেয়ারম্যানের বাড়ি, এনায়েতপুরের মুছা মেম্বার ও একারদ্দির বাড়ি এবং বারাদীর ইয়াছিন ও জেহের সর্দারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সংখ্যায় কম থাকায় এবং অধিকতর ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের বাধা দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
আলমডাঙ্গার একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছিলেন আবুল হােসেন মাস্টার (পিতা ভেরম বিশ্বাস, এরশাদপুর; প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আওয়ামী লীগ কর্মী)। মুন্সিগঞ্জের রাজাকার সিদ্দিক মিয়ার জামাই গােলাম রহমান তাঁকে পাকসেনাদের হাতে ধরিয়ে দিলে তারা তাকে হত্যা করে। আলমডাঙ্গার আরেকজন শহীদ বুদ্ধিজীবী হলেন ডা. বজলুর রহমান (পিতা হাজের আলী, স্টেশনপাড়া)। ১২ই নভেম্বর রাজাকারদের ইঙ্গিতে পাকসেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে হত্যা করে। এছাড়া হাটবােয়ালিয়া ফেরিঘাটে পাকসেনারা আরাে ছয়জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। তারা হলেনদোয়ারকা প্রসাদ জালান (আলমডাঙ্গা), পুস্কারলাল জালান (আলমডাঙ্গা), বসন্ত কর্মকার (আলমডাঙ্গা), কালিপদ মহরী। (আলমডাঙ্গা), সুরুজ জামাদার (থানা কর্মকর্তা) এবং আবুল হােসেন বিশ্বাস (কলকুঠি মালিক)। এরা সকলেই ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক।
ডাউকি ইউনিয়নের ভদুয়া গ্রামের জনপ্রিয় জুতা ব্যবসায়ী ফনি দাস (পিতা জানুকি দাস) আলমডাঙ্গা বাজারে যাওয়ার পথে চারতলা মােড়ে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। জীবন বাঁচাতে তিনি মুখস্থ করা কয়েকটি কলেমা ও সূরা বলায় মুসলমান মনে করে পাকসেনারা তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু শান্তি কমিটির সদস্য আহমদ আলী তার আসল পরিচয় জানিয়ে দিলে পাকসেনারা তাকে হত্যা করে।
পাকসেনারা হাটবােয়ালিয়া যাওয়ার পথে বকশিপুরের খেজের আলী নামক এক মাছ ব্যবসায়ীকে পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্য জোর করে তুলে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে কুমারীতে মাইন বিস্ফোরণে পাকসেনাদের সঙ্গে সেও নিহত হয়। পাকবাহিনী নাগদহ ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রাম ঘেরাও করে গুলি করলে হাবিবুর রহমান (পিতা আমােদ আলী) নামে একজন গ্রামবাসী শহীদ হন। কালিদাসপুর ইউনিয়নের একজন সাধারণ নিরীহ মানুষ লুৎফর রহমান (পিতা সৈয়দ বিশ্বাস, নওদাপাড়া) আলমডাঙ্গা বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে আশাননগর কপাটি ব্রিজের ওপর পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন। এছাড়া কালিদাসপুর গ্রামের মহাতাব উদ্দীন (খুলনা লঞ্চঘাটের লেবার সর্দার) পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন।
ওপরে উল্লিখিত বধ্যভূমি ও গণকবরগুলাে ব্যতীত আলমডাঙ্গা উপজেলায় আরাে কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলাে হলাে- হাটবােয়ালিয়া ফেরিঘাট বধ্যভূমি, মুন্সিগঞ্জ রেলস্টেশন বধ্যভূমি, ওয়াপদা ক্যানেলপাড় গণকবর, আলমডাঙ্গা উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন গণকবর ও প্রাগপুর গণকবর।
আলমডাঙ্গা উপজেলায় ওয়াপদা গার্ড বিল্ডিং, ওয়াপদা রেস্ট হাউজ, মুন্সিগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প ও হাটবােয়ালিয়ার রঘুবাবুর দোতলা পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের উল্লেখযােগ্য যুদ্ধগুলাে হলাে- সুকচাবাজিতপুর যুদ্ধ, হাটবােয়ালিয়ার যুদ্ধ, এনায়েতপুর-বাড়াদির যুদ্ধ, নীলমনিগঞ্জ যুদ্ধ, পাইকপাড়ার যুদ্ধ, অনুপনগর যুদ্ধ, মুন্সিগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, আলমডাঙ্গার যুদ্ধ, আইলহাঁসের যুদ্ধ, কাকিলাদহ যুদ্ধ, কুমারীর যুদ্ধ, বলিয়ারপুর যুদ্ধ, হাটবােয়ালিয়ায় গ্রেনেড হামলা ও রায়সা যুদ্ধ।
সুকচা-বাজিতপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৩ জুলাই। পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এই সম্মুখ যুদ্ধে জামসেদ (নুরিটগর) নামে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। গুলিতে আহত হয়ে মৃত্যুর আগে তিনি তার এলএমজিটি ক্যানেলের গভীর পানিতে ফেলে দেন। রবিউল ইসলাম (নওলামারী) নামে আরেকজন মুক্তিযােদ্ধা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পানিতে ডুব দিয়ে কোনরকমে জীবন রক্ষা করেন। যুদ্ধের পরদিন মুক্তিযােদ্ধারা জামসেদের এলএমজিটি উদ্ধার করেন। এযুদ্ধে দুজন পাকসেনা নিহত হয়।
হাটবােয়ালিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় জুলাই মাসের শেষদিকে। ভাংবাড়ীয়ার মুক্তিযােদ্ধা নজরুল ইসলাম ফুটবল মাঠের কোনায় ছাতিয়ানতলায় হাটবােয়ালিয়া শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবেদ আলীর ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। কিন্তু গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় নজরুল ইসলাম ধরা পড়ে যান। তাঁর সহযােদ্ধা ফজলুল হক জোয়ার্দার (ভাংবাড়ীয়া), আব্দুল বারী ও আবেদ আলী (ছাতিয়ান, গাংনী থানা) খালের মধ্যে পজিশনে ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখে তাঁরা পশ্চাদপসরণ করেন। নজরুলকে শান্তি কমিটির সদস্য ডা. আবেদ আলীর লােকজন নির্মম নির্যাতনের পর পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ। এ ঘটনার পর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বড়বােয়ালিয়ার আব্দুর রহমান ধুনার সঙ্গে গােপন আলাপ করে হাটবােয়ালিয়া পুলিশ ক্যাম্পের চারজন পুলিশ আত্মসমর্পণ করতে চায়। তাদের মধ্যে নুরু এবং আরেকজন অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু অন্য দুজন পালিয়ে আলমডাঙ্গায় চলে যায়। এর একমাস পরে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। হাটবােয়ালিয়ায় গ্রেনেড হামলা হয় আগস্ট মাসের শেষদিকে। এখানকার শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ডা. আবেদ আলী তার লােকজন নিয়ে হাটবােয়ালিয়ায় গােপালবাবুর বাসভবনে প্রতিদিন তাসের আসর বসাত। ঘটনার দিন এখানে উপস্থিত ছিল তৈয়ব মালিতা, রবজেল সাহেব, তাহের আলী ও জলিল রিফুজী। পাহারায় ছিল আকালি ও রাহেল আলী। মুক্তিযােদ্ধা কাজী কামাল ও মারফত আলীর দল হাটুভাঙ্গার দিকে এবং আব্দুল হান্নানের দল হাটবােয়ালিয়া ফেরিঘাটের পূর্বপাড়ে অবস্থান করছিল। মানিকদিয়ার সাহসী মুক্তিযােদ্ধা আব্দুস সাত্তার উক্ত ভবনের দোতলায় গ্রেনেড হামলা করেন। প্রথমটি বিস্ফোরিত হয়নি। দ্বিতীয়টি বিস্ফোরিত হলে তৈয়ব মালিতা আহত হয় এবং অন্যরা পলিয়ে যায়। গ্রেনেড হামলার পর হাটবােয়ালিয়া বাজারের পুলিশ ও রাজাকাররা চুয়াডাঙ্গায় অবস্থান নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা বাজারে অবস্থিত ডা. আবেদ আলীর ঘরটি পুড়িয়ে দেন এবং তার টি-বাের্ডটি আবুরীর গাঙে ডুবিয়ে রাখেন।
নীলমনিগঞ্জ যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বর মাসে। এখানে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। আব্দুস শুকুর বাঙালী এবং কমান্ডার লুৎফর তাঁদের বাহিনী নিয়ে ক্যাম্প আক্রমণ করে অস্ত্রসহ ১৭ জন রাজাকারকে বন্দি করেন। অস্ত্রগুলাে নিজেদের হেফাজতে রেখে রাজাকারদের ভারতের একশন ক্যাম্পে পাঠানাে হয়।
এনায়েতপুর-বাড়াদির যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। ঘটনার দিন কমান্ডার আব্দুল হান্নান রতন তাঁর দলের সদস্য রশিদ উকিল, গণি শেখ, ইজ্জত আলী ও জকুসহ প্রায় ৫০-৬০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পােলতাডাঙ্গায় অবস্থান করছিলেন। তাঁরা খবর পান যে, পাকসেনারা আনন্দবাস পাড়ায় ঢুকে পড়েছে। তখন তারা দ্রুত বাড়াদি গােরস্থানের মধ্যে পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করেন। জবাবে পাকসেনারা কিছুক্ষণ ফায়ার করে মুন্সিগঞ্জ চলে যায়। যাওয়ার পথে ইসমাইল, হুজুর আলী, গঞ্জের সর্দার, নওশেদ সরদার, তৈয়ব, শমসের প্রমুখ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে বেদম প্রহার করে।
রায়সা যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে। এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি ঘাঁটি ছিল। রাজাকার মারফত এ খবর পেয়ে ঘটনার দিন পাকসেনারা হরিনারায়ণপুর থানার পার্বতীপুর ক্যাম্প থেকে নৌকাযােগে খাসকররা যাওয়ার পথে ঘাঁটি আক্রমণ করে। ঘাঁটিতে অবস্থানরত আব্দুস শুকুর বাঙালীর দল ও কুষ্টিয়ার খলিল কমান্ডার এর জবাব দেন। কিন্তু পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযােদ্ধারা তিওরবিলা-গাজিতলায় চলে যান। এরপর পাকসেনারা রায়সা পাড়াটি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়। এখান থেকে খাসকররায় গিয়ে তারা সেখানকার বাজারের একটি পাকুড় গাছে ১৪ই আগস্ট আব্দুস শুকুর বাঙালী কর্তৃক উত্তোলিত স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলে এবং মহাম্মদ মৃধা, সাহাদত হােসেন, বরকত মন্ডল, তালেব মন্ডল প্রমুখের বাড়িঘর লুটপাট করার পর পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এদিন তারা ৭ জন মহিলার সম্ভ্রমহানি করে।
পাইকপাড়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৮ই অক্টোবর। এ-সময় লুৎফর কমান্ডার ২০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে এখানে অবস্থান করছিলেন। রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে শতাধিক পাকসেনা মুন্সিগঞ্জ ক্যাম্প থেকে এসে রাত ১১টার দিকে তাঁদের ঘেরাও করে। বজলুল হক আমিন নামে এক ব্যক্তি মুক্তিযােদ্ধাদের এ সংবাদ দিলে পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বুঝতে পেরে তারা গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কেরুর মাঠের দিকে চলে যান। পাকসেনারা মন্টু খােড়া নামে একজন গ্রামবাসীকে ধরে চরম মারধর করে। তাদের গুলিতে হাবিবুর রহমান (পিতা আমােদ আলী) ও কদভানু (পিতা তাহের আলী) নামে দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন এবং বিশারত নামে এক যুবক আহত হয়।
অনুপনগর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৯ই নভেম্বর। এ-সময় কমান্ডার মতিয়ার রহমান মন্টুর দল পােলতাডাঙ্গা গ্রামে অবস্থান করছিল। এ খবর পেয়ে পাকসেনারা অনুপনগর গ্রামে ঢুকে বাড়িঘর পােড়াতে থাকে। এ সংবাদ শুনে কয়রাডাঙ্গার খাইরুলসহ মন্টুর দল তৎক্ষণাৎ মাথাভাঙ্গা নদী পার হয়ে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকসেনারা পিছু হটে চুয়াডাঙ্গায় পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে বেলগাছির আঙুর নামে একজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে ভারতে পাঠানাে হয়।
যুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধারা বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাবিরােধীকে তাদের অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিশােধ নেয়ার জন্য হত্যা করেন। অক্টোবর মাসে গােবিন্দপুর গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য মফিজ উদ্দীন বিশ্বাসের বাড়িতে অপারেশন চালিয়ে আটজনকে হত্যা করা হয়। ৩রা নভেম্বর সাবেক এমএলএ এবং শান্তি কমিটির সদস্য ইউসুফ মিয়া (এরশাদপুর)-কে আলমডাঙ্গাস্থ তার আড়ৎ থেকে আরাে তিনজনসহ ধরে এনে হত্যা করা হয়। কুমারী ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবুল হােসেন এতটাই অত্যাচারী ছিল যে, তার নিজের পুত্র মুক্তিযােদ্ধা খাইরুল আনাম নিজে তাকে হত্যা করেন।
মুন্সিগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এখানে ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকেই স্থানীয় শান্তি কমিটির লােকজন ও রাজাকাররা এলাকার লােকজনদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে থাকে। এসব বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মতিয়ার রহমান মন্টুর বাহিনী তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। তুমুল যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। তাদের সব অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ২২ জন রাজাকারকে ভারতে পাঠানাে হয়।
আলমডাঙ্গার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১১ই নভেম্বর। এতে আনসার আলী, মােল্লা আবুল হােসেন নান্নু ও খন্দকার আশরাফ আলী আশু নামে ৩ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং জামাল কমান্ডার ও দুলাল আহত হন। এ-সময় মুক্তিযােদ্ধারা ন্যাশনাল ব্যাংকের অর্থ নিয়ে নেন। এক পর্যায়ে তারা আহত জামাল কমান্ডার ও দুলালকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে সক্ষম হন। আইলহাঁসের যুদ্ধ সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। ঘটনার দিন ভাটুই নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নিয়ে পাকসেনারা রাজাকারদের লুটকরা খাসি জবাই করে আহারের আয়ােজন করছিল। এ-সময় মুক্তিযােদ্ধারা নদীর অপর পাড়ে কালীপদ ঘােষের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা খবরটি জানতে পেরে ফায়ার শুরু করেন। পাকসেনারাও ফায়ার করতে-করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু নদীর পাড়ে এসে পানি দেখে ফিরে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা অনবরত ফায়ার করতে থাকলে এক পর্যায়ে রান্না ফেলে রেখে তারা বাগুন্দের দিকে পালিয়ে যায়। পাকসেনাদের গুলিতে আইলহাঁসের জাহিদ নামে এক ব্যক্তি শহীদ হন।
কাকিলাদহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৮শে নভেম্বর মারফত আলী, মনিরুজ্জামান ভুলু, আব্দুল হান্নান, কাজী কামাল ও ফারুকের নেতৃত্বে। এতে ১০-১২ জন কৃষক ও ৫ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। কয়েকজন পাকসেনা আহত ও ত্রিশজনের অধিক রাজাকার অস্ত্রসহ ধরা পড়ে এবং তাদের ভােলাডাঙ্গার নিচে মাথাভাঙ্গা নদীতে ও হাটবােয়ালিয়ার নিচে কুমার নদের উৎসমুখে হত্যা করে মাথাভাঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। কুমারীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। কমান্ডার ওমর ফারুক গােপনসূত্রে অবহিত হন যে, ঐ পথে পাকবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি হাটবােয়ালিয়া যাবে। এ খবর পেয়ে তার দল এবং কাজী কামালের দল একত্র হয়ে কুমারী চৌরাস্তার মােড়ে মাইন পুঁতে রাখে। যথাসময়ে একটি জিপ ও একটি ট্রাক ওখানে এলে মাইন বিস্ফোরণে জিপটি উল্টে যায় এবং ট্রাকটি ঘুরে আলমডাঙ্গার দিকে চলে যায়। জিপের একজন সেনাসদস্য নিহত হয় এবং একজন ছিটকে রাস্তার খাদে পড়লে তাকে জীবিত ধরে হারদীর মােহিনী মােহন শাহ-এর বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়। দেশ হানাদারমুক্ত হলে আলমডাঙ্গার সিও (ডেভেলপমেন্ট)-র নিকট তাকে হস্তান্তর করা হয়।
বলিয়ারপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। এ-সময় কমান্ডার আব্দুস শুকুর বাঙালী, মস্ত সরদার (ঝাঝরি বেগমপুর) ও আতিয়ার (ভেদামারি)-সহ পাঁচজন মুক্তিযােদ্ধা ডিঙ্গেদহ বাজার থেকে পাকসেনাদের সহায়তাকারী দুই বিহারি ও এক কিশােরকে ধরে আনেন। কিশাের ছেলেটি বাঁচার আকুতি জানালে তাকে বাদ দিয়ে অপর দুজনকে কাকলির মাঠে নিয়ে হত্যা করা হয়। এই কিলিং অপারেশন থেকে ফেরার পথে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে দুজন পাঞ্জাবি সেনা আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার করতে-করতে দুবলােকুড়াের বিল সাঁতরে দমদমা ব্যানাগাড়ীর মাঠ হয়ে পাইকপাড়ায় অবস্থান নেন। পরবর্তীতে পাকসেনারা ঐ বিহারি ছেলেটিকে দিয়ে শনাক্ত করিয়ে ঐ এলাকার মুক্তিযােদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচার করে। ৭ই ডিসেম্বর আলমডাঙ্গা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলায় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- এম এ মান্নান, বীর বিক্রম (চন্দ্রা), নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক (কয়রাডাঙ্গা) ও সাইদুর রহমান, বীর প্রতীক (ঘােষালিয়া)।
আলমডাঙ্গা উপজেলায় অনেক মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। ইউনিয়ন অনুযায়ী তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে তুলে ধরা হলাে। ভাংবাড়ীয়া ইউনিয়ন- নজরুল ইসলাম (পিতা দাউদ হােসেন বিশ্বাস, ভাংবাড়ীয়া; হাটবােয়ালিয়ায় শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ডা. আবেদ আলীর ওপর গ্রেনেড হামলাকালে ধরা পড়েন এবং সেই থেকে নিখোঁজ), আব্দুল হান্নান (পিতা সামসুদ্দিন, মহেশপুর), হেফাজ উদ্দীন (পিতা হেদায়েত উল্লাহ বিশ্বাস, ভাংবাড়ীয়া; মার্চের অসহযােগ আন্দোলনের সময় আলমডাঙ্গা থানা পরিষদে প্রথম পদত্যাগকারী, এ কারণে জুলাই মাসে পাকসেনারা তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় হত্যা করে), আফাজ উদ্দীন রতন (পিতা হেফাজ উদ্দীন, ভাংবাড়ীয়া; আলমডাঙ্গা কলেজের ছাত্র এবং ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলনের কর্মী, পিতা হেফাজ উদ্দীনের সঙ্গে তাঁকেও ধরে নিয়ে পাকসেনারা হত্যা করে), মসলেম উদ্দীন (বাঁশবাড়ীয়া; আনসার সদস্য, মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়ে ট্রেনিং শেষে ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ভুলক্রমে দামুড়হুদার জুড়নপুর গ্রামে শান্তি কমিটির সদস্য আলাউদ্দীনের বাড়িতে আশ্রয় নিলে তার চক্রান্তে পাকসেনারা আরাে তিনজন মুক্তিযােদ্ধাসহ তাঁকে হত্যা করে); হারদী ইউনিয়ন- বদর উদ্দীন (পিতা তােবারক মন্ডল, বৈদ্যনাথপুর; যুদ্ধকালীন সময়ে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসার পথে জোড়পুকুর নামক স্থানে গাংনী থানার রাজাকারের হাতে শহীদ), আজিবর (পিতা মহির উদ্দীন, প্রাগপুর; কাকিলাদহ যুদ্ধে শহীদ), খন্দকার তাহাজ্জেল (পিতা খন্দকার মহসিন আলী, ওসমানপুর; ঐ), মােনা খন্দকার (পিতা বাশার খন্দকার, ওসমানপুর; ঐ), জান বকস (পিতা মওলা বকস, ওসমানপুর; ঐ), ওলিমদ্দিন (পিতা মিষ্ট মন্ডল, ওসমানপুর; ঐ); কুমারী ইউনিয়ন তালাত মাহমুদ (পিতা খন্দকার সেলিম উদ্দীন, কুমারী; যুদ্ধে আহত হয়ে গাংনী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন); আলমডাঙ্গা পৌরসভা- মােল্লা আবুল হােসেন নানু (পিতা বাহার আলী মােল্লা, আলমডাঙ্গা স্টেশনপাড়া; ১২ই নভেম্বর আলমডাঙ্গা শহরে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), খন্দকার জামসেদ নুরি টগর (পিতা খন্দকার নুর উদ্দীন, গােবিন্দপুর; ১৩ই আগস্ট সুকচা-বাজিতপুর গ্রামে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), খন্দকার আশরাফ আলী আশু (পিতা খন্দকার সামসুল হক, গােবিন্দপুর; ১২ই নভেম্বর আলমডাঙ্গা শহরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), উম্মাদ আলী (পিতা ইছাহাক আলী, এরশাদপুর; ৩০শে মার্চ কুষ্টিয়া প্রতিরােধ যুদ্ধের পর পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সাহায্যে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে), আকবর আলী (পিতা কালাচান মন্ডল, হাউসপুর; ঐ), মােবারেক আলী দাই (পিতা ফয়েজ উদ্দীন শেখ, এরশাদপুর; বাঁশবাড়ীয়ায় শহীদ); জেহালা ইউনিয়ন কিয়াম উদ্দীন (পিতা রহিম মন্ডল, রােয়াকুলি; ৫ই আগস্ট মেহেরপুর জেলার নাটুদহ-মজমপুরের রতনপুরে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), শুকুর আলী (পিতা কাটি মল্লিক, গড়গড়ি মুন্সিগঞ্জ); খাদিমপুর ইউনিয়ন- ফজলুর রহমান (পিতা রহিম বকস, খাদিমপুর; ভারতের হৃদয়পুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় ছুটি নিয়ে বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে পাকসেনাদের হাতে শহীদ), মুরাদ আলী (পিতা মকছেদ আলী, খাদিমপুর; ঐ), হাবিবুর রহমান (পিতা আবুল হােসেন, বটিয়াপাড়া; ঐ), রওশন আলম (পিতা আজিজুর রহমান, বটিয়াপাড়া; ৫ই আগস্ট মেহেরপুর জেলার নাটুদহ-মজমপুরের রতনপুরে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আলী হােসেন (পিতা রহিম বকস, পাঁচ কমলাপুর; বাঁশবাড়ীয়ায় শহীদ), ফলেহার (পিতা রহিম বকস, খাদিমপুর; যুদ্ধকালীন সময়ে নিজবাড়ি থেকে ধৃত হয়ে পাকসেনাদের হাতে শহীদ), আবিদ হােসেন (পিতা আজিবর রহমান মন্ডল, বটিয়াপাড়া; বিএলএফ কমান্ডার মােজাহারুল ইসলাম ঝন্টুর ট্রেনিং সেন্টার বটিয়াপাড়ার স্কুলমাঠে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় শহীদ), হামিদুর রহমান (পিতা আফছার আলী, বটিয়াপাড়া); চিলা ইউনিয়ন- নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক (পিতা ফতে আলী বিশ্বাস, কয়রাডাঙ্গা; ২৫শে সেপ্টেম্বর নিজ বাড়িতে পাকসেনা ও রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে একাই যুদ্ধ করেন এবং আহত অবস্থায় বন্দি হয়ে অমানুষিক নির্যাতন ভােগের পর শহীদ হন), কমান্ডার হাসান জামান (পিতা ইয়াকুব হােসেন, গােকুলখালী; ৫ই আগস্ট নাটুদহ-মজমপুর যুদ্ধে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আলী হােসেন (পিতা রহিম বকস, পাঁচ কমলাপুর); জামজামি ইউনিয়ন আবু তালেব (পিতা ইমান আলী, পুরাতন পাঁচলিয়া; যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে ট্রেনিং শেষে মাবাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসার পথে জোড়পুকুর নামক স্থানে গাংনী থানার রাজাকারদের হাতে শহীদ), আব্দুল গণি (পিতা মাতু মন্ডল, পুরাতন পাঁচলিয়া; আনসার সদস্য, ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্রসহ দেশে প্রবেশ করে ভুলক্রমে দামুড়হুদার জুড়নপুর গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য আলাউদ্দীনের বাড়িতে আশ্রয় নিলে তার চক্রান্তে পাকসেনাদের হাতে শহীদ), আকবর আলী (পিতা আজগর আলী, পুরাতন পাচলিয়া; ঐ); বেলগাছি ইউনিয়ন- নজরুল ইসলাম (পিতা বানাত আলী, বেলগাছি; যুদ্ধকালীন সময়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসার পথে জোড়পুকুর এরাকায় গাংনী থানা রাজাকারদের হাতে শহীদ); খাসকররা ইউনিয়ন- আক্কাস আলী (পিতা খুসাল মন্ডল, খাসকররা; সীমান্ত এলাকায় পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ); গাংনী ইউনিয়ন- বজলুর রহমান গ্যাজা (পিতা দুলাল মন্ডল, বড়গাংনী; ১৫ই সেপ্টেম্বর বন্দর মাঠ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে এসে ঘুমানাের পর পাকসেনারা বাড়ি ঘেরাও করে ধরে নিয়ে যায় এবং চুয়াডাঙ্গায় হত্যা করে); ডাউকি ইউনিয়ন আবু তালেব (পিতা ইমান আলী, পাঁচলিয়া), মােয়াজ্জেম হােসেন (পিতা তাঁরাচান বিশ্বাস, বকশিপুর); বাড়াদি ইউনিয়ন- আব্দুস সামাদ (এনায়েতপুর; আনসার সদস্য, কুষ্টিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নেন এবং ট্রেনিং শেষে ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে দেশে প্রবেশ করে ভুলক্রমে দামুড়হুদার জুড়নপুর গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য আলাউদ্দীনের বাড়িতে আশ্রয় নিলে তার চক্রান্তে পাকসেনারা ধরে নিয়ে হত্যা করে); আইলহাঁস ইউনিয়নজাহিদ (আইলহাঁস; আইলহাঁস যুদ্ধে শহীদ); নাগদহ ইউনিয়ন- কদভানু (পিতা তাহের আলী, পাইকপাড়া; পাইকপাড়া যুদ্ধে শহীদ)।
আলমডাঙ্গা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পুরাতন বাসস্ট্যান্ড মােড়ে স্বাধীনতা স্তম্ভ ‘৭১, ঘােষবিলায় সাইদুর রহমান, বীর। প্রতীক-এর নামে স্মৃতিফলক এবং কমান্ডার আব্দুল হান্নানের বাড়ির গেটে আলমডাঙ্গা উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের নামফলক নির্মাণ করা হয়েছে। কমান্ডার মাে. জামাল উদ্দীনের নামে পাঁচলিয়া জামাল উদ্দীন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও গােবিন্দপুরে বীর মুক্তিযােদ্ধা সবেদ আলীর নামে এম সবেদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আলমডাঙ্গা থেকে বাবুপাড়া পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ নানু-টগর-আশু সড়ক এবং জামজামি ইউনিয়নের ঘােষবিলা গ্রামে একটি সড়কের নাম সুবেদার বীর প্রতীক সাইদুর রহমান সড়ক রাখা হয়েছে। এছাড়া চিলা ইউনিয়নের রইতনপুর গ্রামে বীর মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলামের নামে একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে এবং আলমডাঙ্গা উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। [কোরবান আলী মন্ডল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!