আলাদিপুর ব্রিজ অপারেশন
আলাদিপুর ব্রিজ অপারেশন (রাজবাড়ী সদর) পরিচালিত হয় ২১শে নভেম্বর। ফরিদপুর জেলা সদর থেকে পাকসেনারা সাঁজোয়া বহর নিয়ে আলাদিপুর ব্রিজ পার হয়ে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালাত। সেই আক্রমণ রােধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবেই মুক্তিযােদ্ধারা এ ব্রিজে অপারেশন চালান। এতে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযােদ্ধারা অনেক আগে থেকেই আশপাশের সড়ক ও রেলপথের ব্রিজগুলাে একে-একে ধ্বংস করে দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে ফরিদপুর জেলা সদর থেকে পাকসেনাদের কোনাে গাড়িবহর যাতে সিএন্ডবি সড়ক ধরে এগােতে না পারে সেজন্য মুক্তিযােদ্ধারা শিবরামপুর, ধুলদি ও গােয়ালন্দ মােড়ে সড়ক কেটে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পাকসেনারা তাই গােয়ালন্দ-ফরিদপুর-কামারখালি সড়কে চলাচল করলেও রাজবাড়ীতে আসতে পারছিল না। এ সাফল্যের পর মুক্তিযােদ্ধারা ২১শে নভেম্বর রাতে আলাদিপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। এজন্য বরাটের রফিকুল ইসলাম কমান্ডারের গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধারাও যােগ দেন। এ অপারেশনের খবর আগে থেকেই জানতে পেরে রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা আলাদিপুর ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে রাস্তার ওপর তৈরি বাঙ্কারে ওঁৎ পেতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ চালালে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল আজিজ খুশি এক পর্যায়ে শত্রুর বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে যান। ঠিক সে-সময় তার মাথার ডান দিকে গুলি লাগে এবং তিনি শহীদ হন। পরের দিন ২২শে নভেম্বর সকালে অপারেশন এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে রাজাকাররা আইনদ্দিন কেরানীর (রাজবাড়ী কলেজ) বাড়ির একজন ক্ষেতমজুর জইনুদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে এবং ধানক্ষেতে খুশির লাশ পেয়ে তারা পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে। কুখ্যাত সৈয়দ খামার রাজবাড়ী থেকে একটি মােটরযান নিয়ে এসে খুশির লাশ তাতে তুলে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর নানাভাবে ঐ লাশের অমর্যাদা করে রাজবাড়ী এনে সারা শহর ঘােরানাে হয়। সৈয়দ খামারের নির্দেশে খুশির নিউকলােনির বাসায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তাদের এ নিষ্ঠুরতার অবসান হলে রাজবাড়ী থানার কর্মকর্তার মাধ্যমে লাশ হাতে পেয়ে বাসার পাশেই সমাহিত করা হয় শহীদ খুশিকে।
খুশির লাশের ওপর এ বর্বরতার কথা ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে প্রতিশােধের আগুন জ্বলে ওঠে। তাঁরা আলাদিপুর বিহারি কলােনিতে হামলা করে বেশ কয়েকজন বিহারি ও রাজাকারকে হত্যা করেন। আলাদিপুর এলাকার আশপাশে অবস্থানকারী মুক্তিযােদ্ধারা বারবাকপুর স্কুলে একত্রিত হয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শত্রুকে মােকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। মূলঘর এলাকার কো-অর্ডিনেশন সেলের সহযােগিতায় হাজার-হাজার মানুষকে একত্রিত করে মহকুমা কমান্ডার শহীদুন্নবী আলম গােয়ালন্দ মােড়ের নিকট পাকা সড়কে ১৮ ফুট বাই ৫ ফুট চওড়া গভীর খাদ তৈরি করেন। এর ফলে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঐ ভাঙ্গা ব্রিজ ও রাস্তার পাশের বাঙ্কারে এবং জঙ্গলে শতশত মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের সহযােগী গ্রামবাসী এম্বুশ করে পাকবাহিনীর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। যথাসময়ে পাকবাহিনীর সাঁজোয়া বহর ফরিদপুর থেকে গােয়ালন্দ মােড়ের এ খাদের পাড়ে এসে দেখে অবস্থা বেগতিক। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের সমর্থনে ঢাকার দিক থেকে আসা ২৩টি বােমারু বিমানকে আকাশে উড়তে দেখা যায়। এ-সময় মুক্তিযােদ্ধারা ওপরের দিকে ২-৩ রাউন্ড মেশিনগানের গুলি ছােড়েন। এতে ভয় পেয়ে বিমানগুলাে ফরিদপুরের দিকে চলে যায়। এদিকে রাস্তাকাটা খাদ পার হতে না পেরে পাকবাহিনীর সদস্যরা ফরিদপুর ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
এদিকে বাঙালি নিধনের জন্য দুটি বাস ও একটি ট্রাকযােগে বিহারি মিলিশিয়ারা সকাল থেকেই বাণীবহ গ্রামে অবস্থান নেয়। তাদের প্রতিহত করতে এরেন্দা দত্তবাড়ি ক্যাম্পের আবুল হাসেমের গ্রুপ, বেজকোলা ক্যাম্পের শহীদুন্নবী। আলমের গ্রুপ এবং আব্দুল জলিলের গ্রুপ বাণীবহ গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মােকলেছারের বাড়িতে অবস্থান নেয়। এ-সময় মােকলেছারের ভাই আব্দুর রহমান মুক্তিযােদ্ধাদের বলেন, তাঁরা যুদ্ধ করলে বাণীবহ গ্রামের লােকজনকে কোনেভাবেই বাঁচানাে যাবে না। তিনি বিহারিদের বুঝিয়েসুজিয়ে ফেরত পাঠাবেন, কারাে কোনাে ক্ষতি করতে দেবেন না। তাঁর কথায় আস্থা রেখে মুক্তিযােদ্ধারা বৃহত্তর স্বার্থে ক্যাম্পে ফিরে যান। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ফিরে যাবার পরপরই বিহারিরা বাণীবহ বাজারের মসজিদে আগুন দেয়। পাশের কুণ্ডুবাড়িসহ পুরাে এলাকা এবং আব্দুর রহমানের বাড়িতেও আগুন দেয়। তারা একজন হিন্দু শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করে এবং তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা ফিরে গিয়ে মূলঘর ও বেজকোলা এলাকায় অবস্থান করার সময় ঘটনার ভয়াবহতা টের পেয়ে বাণীবহ গ্রামে এসে বিহারিদের ওপর আক্রমণ চালান। উভয় পক্ষে প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী বন্দুক যুদ্ধ হয়। এ-সময় কয়েকজন বিহারি পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারলেও তিনজন মিলিশিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। এদিকে কথা রাখতে না পারার ভয়ে আব্দুর রহমান পালিয়ে প্রথমে ফরিদপুর ও পরে ঢাকায় অবস্থান নেয় এবং দেশ স্বাধীনের পর এলাকায় ফিরে আসে। [আবু রেজা আশরাফুল মাসুদ।]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড