আলতাফ মাহমুদ
আলতাফ মাহমুদ (১৯৩৩-১৯৭১) ভাষা-সংগ্রামী, মুক্তিযােদ্ধা, সংগীতশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক। তিনি ১৯৩৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদি থানার পাতারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নাজেম আলী হাওলাদার। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান আলতাফ মাহমুদ। মা শৈশবে মারা যান। ফলে নাজেম আলীর নিঃসন্তান অপর স্ত্রীর কাছে বরিশাল শহরের ফকিরবাড়ি সড়কের বাসায় আপন সন্তানের মতাে মানুষ হন আলতাফ মাহমুদ। তাঁর ডাকনাম ঝিলু। ৫ম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায়ই গান-বাজনা, ছবি আকা ও খেলাধুলায় নৈপুণ্য দেখাতে শুরু করেন তিনি। আরবি সুরা আবৃত্তিতে প্রথমে তিনি সুরেলা কণ্ঠের পরিচয় দেন। সংগীতানুরাগ তাঁকে ক্রমশ সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠকে পরিণত করে। গান গেয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান তিনি মাতিয়ে তুলতেন। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর কিছুদিন বি এম কলেজে আইএসসিতে পড়াশুনা করেন। কলেজে পড়ার সময়েই তিনি বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন। সরকারবিরােধী গণসংগীত পরিবেশন করে তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বরিশাল শহরের খ্যাতিমান বেহালাবাদক সুরেন রায়ের তিনি প্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকা এসে ধূমকেতু শিল্পী সংঘে যুক্ত হয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হন। একই সঙ্গে যুবলীগের সঙ্গেও যুক্ত হন। তাঁর জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের গতিমুখ ছিল সংগীতের। দিকে, বিশেষ করে গণসঙ্গীতের দিকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর সংগীতপ্রতিভা আরাে বিকশিত হওয়ার সুযােগ পায়। তিনি ভাষা-আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে সংগীত পরিবেশন, সংগীত রচনা ও সর্বোপরি সংগীতে সুরারােপ করে খ্যাতি অর্জন করেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’- আবদুল গাফফার চৌধুরীর এ কবিতাটিতে ১৯৫৩ সনে সুরারােপ করে আলতাফ মাহমুদ অমর হয়ে আছেন। ভাষা-আন্দোলন নিয়ে রচিত আরেকটি গানের কথাও এখানে উল্লেখযােগ্য, যার কথা ও সুর দুইই আলতাফ মাহমুদের- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙ্গালি, তােরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত অনেক গানেরই সুরারােপ করেন তিনি। একই সঙ্গে বলা যায়, ঐ কালপর্বে জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে সমবেত ও একক কণ্ঠে সবচেয়ে বেশি সংগীত পরিবেশন করেন আলতাফ মাহমুদ। ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভুবনে এক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তখন তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ। ১৯৫২ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যে-দুটি নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়, তার সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। ভাষা-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও পরিবর্তন সূচিত হয়। আলতাফ মাহমুদ রাজনৈতিক ঘটনাবলিতেও তখন সক্রিয়। ১৯৫৩ সালের শেষদিকে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগে এক জনসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদের উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানে যে নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়, তার সংগীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীর পক্ষে সংগীতের মাধ্যমে প্রচারকার্যে অংশগ্রহণের দায়িত্ব আলতাফ মাহমুদের ওপর অর্পিত হয় বরিশালের মঠবাড়িয়া অঞ্চলে। ঐ নির্বাচনে তাঁর পিতা মুলাদি অঞ্চলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পুত্রের সাহায্য চেয়েও বঞ্চিত হন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ঐ সরকারকে অপসারণ করা হয়। নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন ও গ্রেফতার। আলতাফ মাহমুদের ওপরও হুলিয়া জারি হয়। হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়ানাে আলতাফ মাহমুদের জন্য হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তিনি কিছুদিন বরিশালে এক জেলে পরিবারের সঙ্গে থাকেন।
১৯৫৫ সালে হুলিয়া প্রত্যাহৃত হলে আলতাফ মাহমুদ পুনরায় সংগীত চর্চায় মনােনিবেশ করেন। এ কালপর্ব তিনি দারুণ অর্থকষ্টে অতিবাহিত করেন। এরই মধ্যে ১৯৫৬ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। পাসপাের্টের জন্য করাচি গিয়ে তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্তু ঢাকায় না ফিরে করাচিতেই থেকে যান। করাচিতে বাঙালিদের সহায়তায় তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সংগঠনে উদ্যোগী হন। সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে তাঁর জন্য নানা রকম আনুকূল্য সৃষ্টি হয়। দেবু ভট্টাচার্যের মাধ্যমেই পরিচয় ঘটে পণ্ডিত তিমির বরণের সঙ্গে। সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওস্তাদ কাদের খাঁ, ওস্তাদ রজমান আলী খাঁ, ওস্তাদ ওমরাও বন্ধু খাঁ, ওস্তাদ হাবিব আলী খাঁ প্রমুখের সঙ্গে। করাচি রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠানের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদ ভালােভাবেই জড়িয়ে পড়েন। করাচিতে টেলিভিশনে বাংলা গান শেখানাের একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ঐ কালপর্বে তিনি নিজের সুর ও লেখা ছাড়াও অন্যের লেখা সুরে প্রায় ৪০-৫০টির মতাে মিনি কলের গান রেকর্ড করেন। এ সূত্রে চলচ্চিত্র জগতের কয়েকজন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন এবং চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেবার আমন্ত্রণ পান। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পরিচালক এ জি কারদার তাঁর চলচ্চিত্র ‘জাগে হুয়া সাভেরা’তে কণ্ঠসংগীতে আলতাফ মাহমুদকে আমন্ত্রণ জানান। এ ছবির একমাত্র গান ‘হাম হার নদী কা রাজা’য় কণ্ঠ দিয়ে আলতাফ মাহমুদ মাত করে দেন। এরপর নীলা পর্বত’ ছবির জন্যও কণ্ঠ দেন তিনি। এতেই সন্তষ্ট ছিলেন না আলতাফ মাহমুদ। চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে তােলেন। যন্ত্রসংগীতের অর্কেস্ট্রেশন আর স্টাফ নােটেশনের বিষয়টি বেশ ভালােভাবেই রপ্ত করে ফেলেন। ফলে বেবী ইসলাম যখন ‘তানহা’ ছবির সংগীত পরিচালক হওয়ার প্রস্তাব দেন, তখন আগ্রহভরেই তিনি তা গ্রহণ করেন। ঐ ছবিতে আলতাফ মাহমুদের গাওয়া গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর আরাে কিছু চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে ১৯৬৩ সালে ‘ইসি কা নাম হায় পেয়ার’ নামে একটি ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ঢাকায় আসার পর তাঁর আর করাচিতে ফেরা হয়নি।
১৯৬৩-পরবর্তী ঢাকায় আলতাফ মাহমুদের জীবন আবার পঞ্চাশের দশকের মতাে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রে সংগীত-পরিচালকের দায়িত্ব পালন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, কচিকাঁচার আসরে কিশাের-কিশােরীদের প্রশিক্ষণ দান প্রভৃতি বিচিত্র কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িয়ে পড়েন। জহির রায়হান পরিচালিত ‘বাহানা’, ‘ক্যায়সে কাহাে’, ‘বেহুলা’ প্রভৃতি ছবির সংগীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ। ‘বেহুলা’ ছবি ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করার পর এ ধারার রহিম বাদশা ও রূপবান, কুঁচবরণ কন্যা, সুয়ােরানী দুয়ােরানী, সপ্তডিঙা, ময়ূরপঙ্খি, আলীবাবা, বেদের মেয়ে, মলুয়া প্রভৃতি ছবিরও জনপ্রিয় সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। তাঁর সংগীত পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে অবুঝ মন, এই নিয়ে পৃথিবী, আগুন নিয়ে খেলা, নয়নতারা, দুই ভাই, সংসার, আপন দুলাল ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও গণসংগঠনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়ন-এর সম্মেলনপরবর্তী দ্বিতীয় রাতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদসহ দেশের সেরা প্রায় সকল গণসংগীত শিল্পীই অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারির সকল অনুষ্ঠানে তিনি সংগীত পরিচালনা করেন। ছাত্র ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক সংসদ, সােভিয়েত মৈত্রী সমিতি, কলেজ শিক্ষক সমিতি বা বিভিন্ন হল সংসদের অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৭ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির পরদিন থেকে ক্রান্তি শিল্পী গােষ্ঠীর উদ্বোধন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে যে দুদিনব্যাপী গণসংগীত ও গণনাট্যের আয়ােজন করা হয়, তাতে সংগীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ। একই বছর সােভিয়েত বিপ্লবের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে পল্টন ময়দানে দুদিনব্যাপী যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়, তার সঙ্গেও আলতাফ মাহমুদ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ঐ অনুষ্ঠানের জন্য আমরা ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও ‘আমরা চলি অবিরাম’ নামে দুটি ছায়ানাটকের আয়ােজন করা হয়, যার স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার। উভয় ছায়ানাট্যে সংগীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ। দীর্ঘ চার মাসব্যাপী মহড়া চলে এ অনুষ্ঠানের। এর সংগীত শিল্পী, নৃত্য শিল্পী সবকিছুই বাছাই করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। এ উপলক্ষে শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত ‘আমি স্পার্টাকাস’ গানটিতে অসাধারণ সুরারােপ করে আলতাফ মাহমুদ তাঁর সংগীত প্রতিভার দৃঢ় স্বাক্ষর রাখেন।
এর আগের বছর ১৯৬৬ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ঝিনু বিল্লাহর সঙ্গে। ঝিনু বিল্লাহ-র পরিবারের সকলেই ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। আলতাফ মাহমুদ এ পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হন। কিছুকালের মধ্যেই এক কন্যা সন্তানের জনক হন তিনি। তার একমাত্র কন্যার নাম শাওন মাহমুদ।
১৯৬৮ সালে খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও সংগীত বােদ্ধা সত্যেন সেনের উদ্যোগে গঠিত গণসংগীতের সংগঠন ‘উদীচী’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। ষাটের দশকে বিদ্রোহ কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের ওপর ভিত্তি করে রচিত হাজার তারের বীণা’ নামক নৃত্যনাট্যে সংগীত পরিচালনা করে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন তিনি। প্রথমে এটি লংপ্লে রেকর্ড হিসেবে বের হয় এরং পাকিস্তান টেলিভিশনেও প্রচারিত হয়। এতে গণসংগীত, লােকসংগীত ও আধুনিক সংগীতের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতের মিশ্রণ ঘটিয়ে শীতল সুরধর্মী এক অনবদ্য সংগীত সৃষ্টি করেন আলতাফ মাহমুদ। পরে সংগীত শিল্পী আতিকুল হক ও আলতাফ মাহমুদের যৌথ প্রচেষ্টায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর পটভূমিতে ঐ বছরের একুশের অনুষ্ঠান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিশেষ আবহে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ এ তিন বছরই বিপুল সংগ্রামী অনুপ্রেরণা নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একুশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা হয় এবং সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন অনিবার্যভাবে আলতাফ মাহমুদ।
এরপর আসে ১৯৭১-এর মার্চের সেই অসহযােগ আন্দোলন এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধের কাল। ১৯৬৭ সাল থেকে আলতাফ মাহমুদ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে ৩৭০ আউটার সার্কুলার রােডের এক ভাড়া বাসায় শাশুড়ি, স্ত্রী ও ভাইবােনসহ এক যৌথ পরিবারে বসবাস করেছেন। ৫০-এর দশক থেকেই তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সংগীতচর্চার মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ব্যক্ত করে আসেন। ১৯৭১-এর মার্চ মাসের অসহযােগ আন্দোলনকালে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি যতই স্পষ্ট হতে শুরু করে, আলতাফ মাহমুদের মধ্যে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য রাজনৈতিক সংযুক্তির বােধ তত তীব্রতা লাভ করে। এমনিতেই পুরাে পরিবারটি ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এ সূত্রে দেশপ্রেমের অনুভূতিও তীব্র। ফলে এ কালপর্বে পুরাে পরিবারের মধ্যে ভিন্নতর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুরাে মার্চ মাস জুড়েই আলতাফ মাহমুদকে ঘিরে এ বাড়িতে আসতে থাকেন স্বাধীনতার পক্ষের শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবীরা। আড্ডার ছলে তাঁদের সঙ্গে গােপন বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়, চলে নানা ধরনের পরামর্শ। মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনা ও তাতে কার কী করণীয় সেসব বিষয় এসব আলােচনায় মুখ্য হয়ে ওঠে।
তারপর এল সেই পঁচিশে মার্চের ভয়াবহ কালরাত। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ঠিক বিপরীত দিকে ছিল তাঁদের বাসা। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রথম বাধা দিয়েছিল এখানকার সাহসী পুলিশরাই। যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই তাদের বাসা। পুলিশদেরই পরামর্শে ঐ রাতে পরিবারের সকল সদস্য কিছুটা পেছনে নিরাপদে অন্য কোনাে বাসায় আশ্রয় নিলেও আলতাফ মাহমুদ একা থেকে যান বাসায়। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে পুলিশদের প্রতিরােধ যুদ্ধে সহায়তা করেন তিনি। পুলিশরা প্রতিরােধ ভেঙ্গে পড়ার পর তাদের পালাতে এবং পােশাক পাল্টাতে সহায়তা করেন। পুলিশ সদস্যদের চলে যাওয়ার পর তাদের পােশাক, অস্ত্র প্রভৃতি লুকিয়ে রাখার ব্যাপারেও আলতাফ মাহমুদ সহায়তা করেন। ২৭শে মার্চ সান্ধ্য আইন শিথিল হলে কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরের পুরােহিতরা আলতাফ মাহমুদ ও তাঁর পুরাে পরিবারকে কয়েকদিনের জন্য মন্দিরে আশ্রয় দেন। ১০-১২ দিন পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে পুরাে পরিবার নিজ বাসায় ফিরে আসে। ২৫শে মার্চের কালরাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আলতাফ মাহমুদকে দেশত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ বৃদ্ধি করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কী করা যায় সে পরিকল্পনা করতে থাকেন। গােপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গানের রেকর্ড করে ভারতে পাঠানাের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু প্রথম দফা তাঁর পাঠানাে রেকর্ড সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ধরা পড়ে গেলে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ঢাকা শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ বাড়তে থাকে। তাদের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদের গােপন যােগাযােগ তৈরি হয় এবং তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছদ্মবেশে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধারা এসে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং এভাবে চিঠি ও লিফলেটের লেনদেন চলে। ঢাকায় গেরিলা আক্রমণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে গােলা-বারুদ আসা শুরু হয়, আসে বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য। এ প্রক্রিয়ায় ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রােডের বাড়িটি ক্রমশ দুর্গবাড়িতে পরিণত হয়। এরই মধ্যে ক্র্যাক প্লাটুন-এর গেরিলা মুক্তিযােদ্ধারা ঢাকায় বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন সম্পন্ন করেন। এতে তাদের সাহস যেমন বেড়ে যায়, তেমনি আক্রমণের প্রবল ঝুঁকি নিতেও তারা কার্পণ্য করেননি। ফলে, তাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণও তীব্র হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে অস্ত্রের একটি বড় চালান আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বেপরােয়া আক্রমণের মধ্যে আগস্টের শেষদিকে ক্র্যাক প্লাটুনের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা ধরা পড়েন। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে বন্দি মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে গােপনে মজুদ অস্ত্রের কথা ফাঁস হয়ে যায়।
এ পটভূমিতে ১৯৭১ সালের ৩০শে আগস্ট প্রত্যুষে পাকিস্তানি বাহিনী আলতাফ মাহমুদের বাড়ি ঘেরাও করে সরাসরি তাঁকে অস্ত্রের কথা জিজ্ঞেস করে। নির্যাতনের মুখেও আলতাফ মাহমুদ প্রথমে অস্বীকার করলেও যখন বুঝতে পারেন নিশ্চিত খবর জেনেই তারা এসেছে, তখন ঘরের পেছনে কাঁঠাল গাছের পাশে লুকিয়ে রাখা অস্ত্রের ট্রাঙ্ক দেখিয়ে দেন। পাকিস্তানি বাহিনী আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে বাড়ির সকল পুরুষ সদস্যকে ধরে নিয়ে যায়।
সেনাবাহিনীর জিপে করে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁওয়ে ড্রাম ফ্যাক্টরির পাশে এমপি হােস্টেলে মিলিশিয়া বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সে। সেখানে নিয়ে আলতাফ মাহমুদসহ অন্যদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। অন্যরা নির্দোষ হওয়ায় আলতাফ মাহমুদ সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে নেন। বাড়ির অন্য কেউ কিছু জানেন না বলে বারবার স্বীকারােক্তি করেন। অতঃপর তাঁকে প্রবলভাবে নির্যাতন করা হয় কারা এসব অস্ত্র এনেছে তাঁদের নাম জানার জন্য। কিন্তু শত নির্যাতনের মুখেও আলতাফ মাহমুদ কারাে নাম প্রকাশ করেননি। ৩০শে আগস্ট সারাদিন নির্যাতন শেষে রাতে তাঁদের পাঠিয়ে দেয়া হয় রমনা থানায়। পরদিন ৩১শে আগস্ট সকালে পুনরায় ঐ স্থানে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের মাত্রা আরাে বাড়িয়ে দেয়া হয়। আলতাফ মাহমুদকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ৩১শে আগস্ট বিকেলে বাড়ির অন্যদের ছেড়ে দেয়া হলে তারা ঘরে ফিরে আসেন। সঙ্গীরা আলতাফ মাহমুদের সর্বশেষ মৃতবৎ অবস্থা দেখে এসেছিলেন। আলতাফ মাহমুদকে ছেড়ে দেয়া দূরের কথা, তার আর কোনাে খোঁজই পাওয়া যায়নি, এমনকি তাঁর মরদেহও পাওয়া যায়নি। এভাবে মাত্র ৩৮ বছরে শেষ হয় দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, সুরকার, অমর একুশের গানের শিল্পী ও সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদের জীবন। [সৈয়দ আজিজুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড