আলফাপুর যুদ্ধ
আলফাপুর যুদ্ধ (শ্রীপুর, মাগুরা) সংঘটিত হয় দুবার – ৪ঠা আগস্ট ও ৩০শে আগস্ট। মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন (শৈলকুপা উপজেলার সীমান্তবর্তী) আলফাপুর গ্রামে সংঘটিত এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
যুদ্ধের শুরু থেকেই আলফাপুরে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। এ কারণে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের কড়া দৃষ্টি ছিল আলফাপুরের প্রতি। ৪ঠা আগস্ট শৈলকুপা উপজেলার আবাইপুর ক্যাম্প থেকে ৫০-৬০ জন মুক্তিযােদ্ধা আলফাপুর ক্যাম্পে আসেন। দালালদের মাধ্যমে এ খবর পৌছে যায় পাকসেনাদের কাছে। তাই ঐদিনই শ্রীপুর, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা ও শৈলকুপা ক্যাম্প থেকে এক প্লাটুন পাকসেনা আলফাপুরের দিকে অগ্রসর হয়। এ খবর শুনে মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের মােকাবেলায় প্রস্তুত হন। সকাল ১০-১১টার দিকে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় এবং একটানা বিকেল পর্যন্ত চলে। বিকেলের দিকে পাকবাহিনী শৈলকুপা উপজেলার বগুড়া বাজার থেকে ক্রমাগত মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। মর্টারের গােলা এড়াতে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন করে পাকসেনাদের ওপর অব্যাহত আক্রমণ চালিয়ে যান। পাশাপাশি গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চলিয়েও পাকসেনাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ তীব্রতর হয়। ফলে পাকসেনারা পালিয়ে শৈলকুপা ও মাগুরার পথে চলে যায়। যুদ্ধে ১৫-২০ জন পাকসেনা নিহত হয় ও দুজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। পাকসেনাদের ৭৫টি রাইফেল ও ১০০-১৫০টি মিলিটারি ব্যাজ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
পরে শ্রীপুর থেকে বিপুল সংখ্যক পাকসেনা এসে তাদের নিহত সৈনিকদের লাশ নিয়ে যায় এবং যাওয়ার সময় ৩-৪ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে কুমার নদে ফেলে দেয়। আলফাপুরের এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার বিশারত আলী। তার সঙ্গে আরাে ৫০-৬০ জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। তারা হলেন: কামরুজ্জামান, দবিরউদ্দিন জোয়ার্দার, আব্দুস সাত্তার (মনােহরপুর), চাদ (বগুড়া), ফরিদ, আবু তৈয়ব, বাবলু, লাড়ু, কাউসার, মােতাহার হােসেন, আকামত আলী, ইজাহার আলী প্রমুখ। এ-যুদ্ধের সাফল্যে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ও সাহস শতগুণে বৃদ্ধি পায়।
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ঝিনাইদহ এলাকার সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত দেড় থেকে দু-হাজার এবং স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরাে দু থেকে আড়াই হাজার মুক্তিযােদ্ধা অসীম সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জেলার প্রধান-প্রধান ঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের ব্যতিব্যস্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখেন এবং একের পর এক তাদের ধ্বংস করতে থাকেন।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই আলফাপুর গ্রামের শিকদার পরিবার প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তাদের পরিত্যক্ত বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি ঘাঁটি গড়ে ওঠে। এ ঘাঁটিতে ৮০-১০০ জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান করতেন। ২৯শে আগস্ট সন্ধ্যার পর তাঁরা খবর পান যে, মাগুরা শহর থেকে শ্রীপুর হয়ে এবং ঝিনাইদহ শহর থেকে শৈলকুপা হয়ে পাকসেনা ও তাদের দোসররা ঘাঁটি আক্রমণ করতে আসছে। খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধারা দ্রুত আলফাপুর ওয়াপদা ড্রেনেজ ক্যানেলের মাথায় পূর্বে খনন করা পরিখায় অবস্থান নেন। হানাদাররা এদিন রাতে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। কিন্তু ঘাঁটিতে মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং আলফাপুর ও পার্শ্ববর্তী মীনগ্রামে ঢুকে বাড়িঘরে লুটতরাজ শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভীত-সন্ত্রস্ত লােকজন পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। সকাল ১০-১১টা পর্যন্ত এ তাণ্ডব চলে।
৩০শে আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে পাকসেনা ও তাদের দোসররা ড্রেনেজ ক্যানেল ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। তখন ক্যানেলের অপর পাড়ে পরিখার মধ্যে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা একযােগে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। প্রথম আঘাতেই শতাধিক পাকসেনা, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস নিহত হয়; আহত হয় আরাে অনেকে। হতবিহ্বল পাকসেনারা দ্রুত পিছু হটে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। দেড় থেকে দুঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর শৈলকুপা সদর থেকে আরাে বেশকিছু পাকসেনা এসে যুদ্ধরত পাকসেনাদের সঙ্গে যােগ দেয়। বিকেলের দিকে পাকসেনারা ভারী মেশিনগান ও মর্টার ব্যবহার করে। মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল করিম (মীনগ্রাম) মর্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে কৌশলগত কারণে মুক্তিযােদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করে গড়াই নদী পার হয়ে নৌকাযােগে হাওড়ের মধ্য দিয়ে পাংশা উপজেলার কলিমহর গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন।
আলফাপুরের এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার রহমত আলী মন্টু। অন্য যারা অংশ নেন তারা হলেন: কমান্ডার বিশারত আলী, দবিরউদ্দিন জোয়ার্দার, কামরুজামান, আব্দুল করিম, আব্দুস সাত্তার, সাজেদুর রহমান, রজব আলী বিশ্বাস, লিয়াকত আলী, আব্দুল জব্বার, লাডডু মিয়া, রওশন আলী, আব্দুল বারিক, শমসের আলী, কাওছার আলম, সূর্য, গােলাম মােস্তফা, মাহবুবুর রহমান, আবু তৈয়ব প্রমুখ। যুদ্ধে বেশকিছু অস্ত্র, হেলমেট, পাকসেনাদের কার্ড ও র্যাংক ব্যাজ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। সেগুলাে দুজন মুক্তিযােদ্ধাকে দিয়ে ভারতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর দুদিন পর এ-যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের অসাধারণ বীরত্ব ও সাফল্যের কাহিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়। [মাে. আব্দুল ওহাব]।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড