You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনী

আলবদর বাহিনী পাকিস্তানের দখলদার সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালে অধিকৃত বাংলাদেশে যে নারকীয় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তাতে তাদের অন্যতম সহযােগী ছিল দেশীয় ঘাতক আলবদর বাহিনী, যারা বিশেষত বুদ্ধিজীবী হত্যায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে। মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর সঙ্গে এ সংগঠনের মতাদর্শিক সম্পর্ক ছিল। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান-এর সংগঠক সেলিম মানসুর খালেদ কর্তৃক লিখিত ও লাহাের থেকে প্রকাশিত উর্দু গ্রন্থ আলবদর থেকে জানা যায় যে, ১৯৪৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর লাহােরে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানএর ছাত্র সংগঠন ইসলামী জমিয়তে তালেবা পূর্ব বাংলায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে ১৯৫০ সালে (বাংলায় যার নামকরণ করা হয় ইসলামী ছাত্র সংঘ)। ‘ইসলামী বিপ্লব’ ও অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এ সংগঠনটি শেষ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং এ সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। যুদ্ধের গােড়া থেকেই জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান চেয়েছে তাদের দলীয় কর্মীদের নিয়ে একটি নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গঠন করতে। সেসুযােগ সৃষ্টি হয় ৭১-এর ২২শে এপ্রিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনী জামালপুর দখল করার পর। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর রিয়াদ হুসাইন মালিকের তত্ত্বাবধানে সেখানে প্রথম আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। তবে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম সূত্রে জানা যায় যে, ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মাে. আশরাফ হােসাইনের নেতৃত্বে ২২শে এপ্রিল ১৯৭১ আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানের কুহাট সেনা ছাউনিতে ১লা জুন ১৯৭৫ তারিখে নেয়া মেজর রিয়াদ হুসাইনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সেলিম মানসুর খালেদ জানিয়েছেন যে, ইসলামী ছাত্র সংঘের ৪৭ জন বাছাইকৃত কর্মীকে নিয়ে আলবদরের সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয় ১৬ই মে জামালপুরের পার্শ্ববর্তী শেরপুরে। অন্যদিকে, তার আগের দিন অর্থাৎ ১৫ই মে ইসলামী ছাত্র সংঘের ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কমিটির বৈঠক থেকে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের নিয়ে আলাদা একটি রাজাকার ফোর্স গঠনের প্রস্তাব তােলা হয়। রাজাকার ফোর্স যথেষ্ট কার্যকর না হওয়ায় এবং পাকিস্তানের প্রতি ‘একনিষ্ঠ, বিশ্বস্থ ও পাকিস্তান-প্রেমী একটি বাঙালি গ্রুপ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দরকার ছিল বিধায় সেকাজে এগিয়ে আসে ইসলামী ছাত্র সংঘ। ঢাকায় ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মেজর জেনারেল আবদুর রহীমের সঙ্গে দেখা করে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, হিন্দুস্তানী অনুচরদের তৎপরতা দমন ও আলবদরের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে আলােচনা করে এবং জেনারেল আবদুর রহীম বিষয়টি নিয়ে জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে দেখা করার পর সে আলবদর বাহিনী গঠনের অনুমােদন দেয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহসানউল্লাহকে দায়িত্ব দেয়া হয় আলবদর বাহিনী গঠনের ব্যাপারে নির্দেশ পাঠানাের, আর ব্রিগেডিয়ার বশীর ঢাকা শহরে আলবদর বাহিনীর ইনচার্জ নিযুক্ত হয়। এ বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয় ঢাকার ধানমন্ডিতে। তিনটি কোম্পানি দিয়ে ঢাকায় আলবদরের অপারেশন শুরু হয়-
১. শহীদ আবদুল মালেক কোম্পানি – কোম্পানি কমান্ডার মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
২. শহীদ আজিজ ভাট্টে কোম্পানি – কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হক
৩. গাজী সালাউদ্দিন কোম্পানি – কোম্পানি কমান্ডার মুহাম্মদ আশরাফুজ্জামান।

পরবর্তীতে এর বিস্তার সম্পর্কে খুব একটা তথ্য জানা যায় না। ১৯৭১ সালে ঢাকায় আলবদরের অন্যতম অপারেশন ইনচার্জ ছিল চৌধুরী মঈনুদ্দীন, তবে কমান্ড কাঠামােয় কোনাে ইউনিটের সঙ্গে তার সংযুক্তি ছিল কি-না, তা স্পষ্ট নয়। মুহাম্মদ আশরাফুজ্জামান নিজে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন শিক্ষককে হত্যা করেছে তার প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য আছে। চৌধুরী মঈনুদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও সাংবাদিক হত্যায় নেতৃত্ব দেয়।
সামরিক ট্রেনিং: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে আলবদর সদস্যদের প্রথমে ৭-১২ দিনের সামরিক ট্রেনিং দেয়া হয়। ট্রেনিং-এর সময় অস্ত্র খােলার কৌশল, অস্ত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া, বিস্ফোরক ও মাইন অকেজো করা শেখানাে হয়। যেমন- ব্রেনগান, থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, মর্টার, এন্টি-এয়ারক্রাফট গান, হ্যান্ডগ্রেনেড, মাইন, গানবােট, রিভলবার ইত্যাদি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং দেয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করতেন। রুশ ও ভারতীয় অস্ত্র। তাদের কাছ থেকে সেই অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার কৌশলও শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে-সঙ্গে ওয়ারলেস বার্তা ব্যবহারের ট্রেনিংও দেয়া হয়। এছাড়াও প্রয়ােজনমতাে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার চালানাের ট্রেনিং আলবদর-এর সদস্যদের দেয়া হয়েছিল।
চিন্তাধারাগত ট্রেনিং: আলবদর ক্যাডারদের চিন্তাধারাগত ও আদর্শিক প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে জিহাদের দর্শন, পরকালের চিন্তা, পারস্পরিক আত্মসমালােচনা, দোয়া প্রভৃতি। ট্রেনিং শেষে প্রত্যেক মুজাহিদকে শপথ বাক্য পাঠ করতে হতাে।
কর্মবণ্টন: প্রতিরক্ষার দায়িত্বগুলাে সুচারুভাবে পালন করার জন্য প্রত্যেক ইউনিটকে তিনটি শাখায় ভাগ করা হয়েছিল ১. জনসংযােগ বিষয়ক দপ্তর; ২. প্রতিরক্ষা বিষয়ক দপ্তর; ৩. তথ্য বিষয়ক দপ্তর।
সাংগঠনিক কাঠামাে: আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল মতিউর রহমান নিজামী। তার ভাষায় পাক সেনার সহযােগিতায় এদেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদরের যুদ্ধে মুসলমান যােদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩১৩, তার অনুকরণে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে আলবদরের প্রতিটি ইউনিট গঠন করা হয়। আলবদরের সাংগঠনিক কাঠামাে ছিল নিম্নরূপ:
১-ইউনিট ৩১৩ ক্যাডেট
২-ইউনিট তিন কোম্পানি, প্রত্যেক কোম্পানিতে ১০৪ জন মুজাহিদ
১-কোম্পানি তিন প্লাটুন, প্রত্যেক প্লাটুনে ৩৩ জন সাজি;
১-প্লাটুন তিন সেকশন টুপ, প্রত্যেক ট্রপে ১১ জন আলবদর ছিল।
প্রত্যেক ইউনিটে ছিল একজন কমান্ডার ও দুজন সেকেন্ড কমান্ডার।
বেতন: আলবদর সদস্যদের মাসিক মাথাপিছু ৯০ টাকা করে বেতন দেয়া হতাে। এছাড়াও আলবদর কর্মীরা যাতায়াত ও খাদ্যাদি সুবিধাদি পেত।
সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীর অধিকতর বাছাইকৃত সদস্যদের নিয়ে এ বাহিনী পুনর্গঠিত হয়। আলবদর বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীই যুগিয়েছে। আলবদরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল মােহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলবদরের সম্পর্কের বিষয়টি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নােটে উল্লেখ রয়েছে। রাও ফরমান আলীর অফিস কক্ষ থেকে উদ্ধার করা চিরকুট থেকে আলবদর দিয়ে অভিযান পরিকল্পনার প্রস্তুতির প্রমাণ মেলে। আলবদর বাহিনী গঠন করার সঙ্গে-সঙ্গেই ইসলামী ছাত্র সংঘ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল করে প্রশিক্ষণ ও নির্যাতন কেন্দ্র তৈরি করেছিল। তাদের কার্যকলাপ প্রমাণ করে যে, আলবদর ছিল একটি পরিপূর্ণ আধা-সামরিক বাহিনী।
পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অটুট রাখার পক্ষে তারা সর্বদা সােচ্চার ছিল। ৭১-এর ১৭ই সেপ্টেম্বর রাজাকার বাহিনীর প্রধান এবং শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে গােলাম আজম ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে যায়। জামাতে ইসলামীর পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধকালে লিখেছে যে, বদর বাহিনী ‘হিন্দু বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে। উল্লেখ্য, ৭১-এর মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের কার্যকলাপ অধিকতর বিস্তৃত হয় এবং কৌশল পরিবর্তন করে তারা আরাে সুসংগঠিত হন। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থায় তারা প্রবল বাধার সৃষ্টি করে। ফলে রাজাকার বাহিনীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সুবিধাবাদী অংশটি ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে পাকিস্তানি বাহিনী আলবদর বাহিনীর শক্তির ওপর নির্ভর করতে থাকে। আলবদর বাহিনী এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেমিনার, সিম্পােজিয়াম, মিছিল, মিটিং করে মুক্তিযােদ্ধাদের ‘বিছিন্নতাবাদী’, ‘ভারতীয় চর’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে তাদের কঠোর সমালােচনা করে। পাশাপাশি সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী তৎপরতা যথাহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাতে থাকে। পাকিস্তান ও ইসলামকে সমার্থক করে দেশের সর্বস্তরে তারা উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করে।
বদর দিবস উদযাপন: ৭ই নভেম্বর ইসলামী ছাত্র সংঘ সারা দেশে বদর দিবস পালনের আহ্বান জানায়। ঢাকার বায়তুল মােকাররমে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মুহাম্মদ শামসুল হকের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ নিম্নলিখিত চার দফা ঘােষণা দেয়দুনিয়ার বুক থেকে হিন্দুস্থানের নাম মুছে না দেয়া পর্যন্ত আমরা বিশ্রামে যাব না। আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের কোনাে বই লাইব্রেরিতে রাখা বা বিক্রি করা বা প্রচার নিষিদ্ধ। তাদের বই পেলে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হবে। পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি। বায়তুল মােকাদ্দাস উদ্ধারের সংগ্রাম চলবে। সমাবেশ শেষে বায়তুল মােকারররম প্রাঙ্গণ থেকে স্লোগান সহকারে একটি মিছিল শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের স্লোগান ছিল: আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে; বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধর, ভারতকে খতম কর; বীর মুজাহিদ এগিয়ে চল, কোলকাতা দখল কর; বদর দিবস সফল হােক; ভারতের চরদের খতম কর খতম কর।
পরের দিন বিভিন্ন দৈনিকে তাদের কার্যকলাপ প্রচার করা হয়। পত্রিকার শিরােনাম ছিল রাজধানীতে বদরবাহিনীর মিছিল – হাতে নাও মেশিনগান খতম কর হিন্দুস্তান। বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণ থেকে জিন্না এভিন্যু (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভি), নবাবপুর রােড হয়ে সদরঘাটে গিয়ে শেষ হয় আলবদর বাহিনীর মিছিল। আরাে যেসব স্লোগান দেয়া হয়, তার মধ্যে ছিল: কাশ্মির পাঞ্জাব নিয়ে নাও, বীর বাহিনী এগিয়ে যাও; ভারতকে খতম কর; হাতে নাও মেশিনগান, খতম কর হিন্দুস্থান; আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবেই। ‘বদর দিবস’ পালনের মধ্য দিয়ে তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার দৃঢ় সংকল্প ঘােষণা করেছিল।
আলবদর হাইকমান্ড-এর দায়িত্ব বণ্টন ছিল নিম্নরূপ-
১. মতিউর রহমান নিজামী – সমগ্র পাকিস্তানের প্রধান ২. আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ – পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান ৩. মীর কাশেম আলী – চট্টগ্রামের প্রধান, পরে ঢাকার ৩য় প্রধান ৪. মােহাম্মদ ইউনুস – কমান্ডার ইন চিফ ৫. মােহাম্মদ কাজিম উদ্দিন – কেন্দ্রীয় প্রচার কার্যক্রমের প্রধান ৬. আশরাফ হােসেন – ময়মনসিংহ জেলা প্রধান ৭. মােহাম্মদ শামসুল হক – ঢাকা শহরের প্রধান ৮. মােস্তফা শওকত ইমরান ৯. আশরাফুজ্জামান খাঁন – বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম জল্লাদ ১০. এ এস এম রুহুল কুদ্দুস ১১. সরদার আব্দুস সালাম – ঢাকা জেলা প্রধান ১২. খুররম মুরাদ – আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী ১৩. আব্দুল বারী – জেলা প্রধান, জামালপুর ১৪. আব্দুল হাই ফারুকী – জেলা প্রধান, রাজশাহী। ১৫. আব্দুল জাহের মাে. নাসির – মীর কাশেম আলীর পরে চট্টগ্রাম জেলা প্রধান ১৬. মতিউর রহমান খান – জেলা প্রধান, খুলনা ১৭. চৌধুরী মঈনউদ্দিন – বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের অপারেশন ইনচার্জ ১৮. নূর মুহাম্মদ মল্লিক – ঢাকা শহরের নেতা ১৯. এ কে মুহাম্মদ আলী – ঢাকা শহরের নেতা।
রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণে বাংলাদেশে একটির পর একটি মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি হতে থাকে। অক্টোবর থেকে আলবদর বাহিনীর কার্যক্রমের মধ্যে ছিল রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা। আলবদর সদস্যরা এ-সময় বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করে তাদের তালিকা প্রস্তুত করে অপহরণ, বন্দি, নির্যাতন করে হত্যা কার্যকে এগিয়ে নেয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি আদর্শগত লড়াই। পাকিস্তানপন্থী আলবদর বাহিনী বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানি আর্দশ ও অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা হবেন তাদের প্রধান প্রতিবন্ধক, আর সে-কারণেই তারা বুদ্ধিজীবীদের সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। ৭১-এর ১২ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রশাসন তাদের আসন্ন হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে’ – লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান ১৩ই ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীকে এ সংবাদ জানালে ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রতিরক্ষার বিষয়টি নিরঙ্কুশ করার জন্য ২৪ ঘণ্টা কারফিউ জারি করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আলবদর বাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে-বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পেশাজীবীদের ধরে এনে আটক করে। পরবর্তীতে তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। বদর বাহিনীর ‘মাস্টার প্লান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ছিল ‘শুধু রাজধানী নয়, বাংলাদেশের সর্বত্র বুদ্ধিজীবী এবং উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণীকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করে দিতে হবে।… বাংলাদেশ যদি আর দু’একদিন অবরুদ্ধ থাকতাে তাহলেই গােটা পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হতাে বদর বাহিনীর। বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী অসংখ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, আইনজীবী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, চিন্তাবিদ, বিভিন্ন পেশায় দক্ষ ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞদের হত্যা করে বাংলাদেশের মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে ফেলে একটা শূনত্যা সৃষ্টি করার জন্যই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এ কাজটি বাস্তবায়ন করে আলবদরদের দিয়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যায় সাহায্যকারী দলগুলাের মধ্যে জামাতে ইসলামী ছিল সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। মওদুদী, গােলাম আজম, আব্দুর রহীমের নেতৃত্বে পরিচালিত জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতার পাশাপাশি লক্ষ-লক্ষ মানুষকে হত্যা করার কাজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সক্রিয় সহযােগিতা করে।
১৪ই ডিসেম্বর ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে বাংলা একাডেমি কর্তৃক শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যে-সকল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং চিকিৎসাবিদ পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও আলবদর বাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন, এতে তার একটি পরিসংখ্যান দেয়া হয়। অসম্পূর্ণ এ পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, গােটা বাংলাদেশে ২১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ৯৬৮ জন শিক্ষাবিদ এবং ৪১ জন সাংবাদিককে তারা হত্যা করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এর বিচারে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খাঁন ও চৌধুরী মঈনউদ্দিনকে প্রাণদণ্ড প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু তারা দুজনেই ১৯৭২ সাল থেকে পলাতক বিধায় তা কার্যকর করা যায়নি। আশরাফুজ্জামান খাঁন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মঈনউদ্দিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছে। তবে আলবদর বাহিনীর প্রধান দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাণদণ্ড প্রদান করে এবং তা যথাক্রমে ১০ই মে ২০১৬ ও ২১শে নভেম্বর ২০১৫ কার্যকর করা হয়েছে। [মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসী]
তথ্যসূত্র: সেলিম মানসুর খালেদ, আলবদর, লাহাের, তালাবা প্রকাশনা দপ্তর ২০১০; সাইফুল ইসলাম খান (অনূদিত) পাণ্ডুলিপি, ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত; দৈনিক সংগ্রাম; শরীফ উদ্দীন আহমেদ (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ১৯৭১, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সােসাইটি ২০১০; মুনতাসীর মামুন, রাজাকার সমগ্র, ঢাকা, অনন্যা ২০০৯; দৈনিক বাংলা; মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধ কোষ, প্রথম খণ্ড, ঢাকা, সময় প্রকাশন ২০০৫; মঈদুল হাসান, মূলধারা’৭১, ঢাকা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ১৯৮৬; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশ-এ উপস্থাপিত আসামী মাে. আশরাফুজ্জামান খান সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্তকারী কর্মকর্তা মাে. শাহজাহান কবীর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার ক্রমিক নং ০৮, তারিখ ২৫-৯-২০১১, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত; দৈনিক পাকিস্তান; দৈনিক আজাদ; ড. আহমেদ শরীফ, কাজী নূর-উজ্জামান ও শাহরিয়ার কবির (সম্পাদিত), একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, ঢাকা, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র ১৯৮৭

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড