আয়লা-বিদ্যানগর যুদ্ধ
আয়লা-বিদ্যানগর যুদ্ধ (করিমগঞ্জ, কিশােরগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১০ই নভেম্বর। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৭ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।
আয়লা ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে হলাে বিদ্যানগর, কিরাটন, মাদারিখলা, সিদলারপাড় ও বাহাদুরপুর। এ গ্রামগুলাে থেকে ১৪-১৫ জন যুবক মার্চের শুরুতেই ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। এ-কারণে উক্ত এলাকার প্রধান দুটি গ্রাম আয়লা ও বিদ্যানগর স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর রােষানলে পড়ে। অক্টোবর মাস থেকে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, আয়লা থেকে করিমগঞ্জের পূর্ব অংশ স্বাধীন বাংলা, আর পশ্চিম অংশ পাকিস্তান। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৩০-৩৫ জন মুক্তিযােদ্ধা অস্ত্রসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযােগিতায় আয়লা ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলােতে এসে অবস্থান নেন। ২৮শে অক্টোবর তাঁরা চামড়াবন্দর যাওয়ার প্রধান রাস্তায় নরসুন্দা নদীর ওপর ফেরুয়াবাড়ি ব্রিজটি বােমা মেরে উড়িয়ে দেন। সঙ্গে-সঙ্গে এ খবর পৌঁছে যায় কিশােরগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের নিকট পরের দিন সকালে পাকসেনাদের গাড়িবহর সাকুয়া ফেরুয়াবাড়ি ব্রিজ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসে। করিমগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আ. মান্নান তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড নাছির উদ্দিনসহ রাজাকার বাহিনীর নেতৃস্থানীয়রা তখন থেকে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারা বড়-বড় গ্রুপে এসে আয়লা ও বিদ্যানগর গ্রামে চক্কর দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা স্থানীয় কাদিরের স্কুলে অবস্থান নিলেও রাজাকারদের আগমনের সংবাদ পাওয়া মাত্র আত্মগােপন করেন। ইতােমধ্যে কিশােরগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের তরফ থেকে রাজাকার কমান্ডের কাছে নির্দেশ আসে যে, তারা যেন মুক্তিবাহিনীর আস্তানায় আক্রমণ করে। এ নির্দেশ পেয়ে রাজাকার বাহিনী ১০ই নভেম্বর সকালে আয়লা স্কুলের দিকে অগ্রসর হয়। তারা সংখ্যায় ছিল আনুমানিক ৬০-৭০ জন। পাকবাহিনীর কিছু সংখ্যক সৈন্য তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। এ সময় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাগুলি হয়। এতে একজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। তাঁকে নিয়ে অন্য মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে পূর্ব দিকে সরে যান। মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে রাজাকার ও পাকবাহিনী বেপরােয়া হয়ে ওঠে। তখন তারা গ্রামে ঢুকে যাকে পায় তাকেই হত্যা করে। পাকসেনারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট ও নারী ধর্ষণ করে চলে যায়। কিন্তু রাজাকার বাহিনী নাছিরের নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড চালায় এবং সন্ধ্যার দিকে করিমগঞ্জ সদরে ফিরে যায়। পরের দিন আবারাে তারা এখানে এসে ২-৩ জনকে হত্যা করে। রাজাকাররা দুদিনে এখানে ১৭ জন লােককে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ১৬ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- আব্দুল বারিক (পিতা আসালত বেপারী, বিদ্যানগর), চান্দু মিয়া (পিতা আবিদ মিয়া, বিদ্যানগর), আব্দুল মালেক মালু (পিতা চান্দু মিয়া, বিদ্যানগর), হবি মিয়া (পিতা হাছেন আলী, আয়লা), মিয়া হােসেন (পিতা আসালত, আয়লা), আব্দুল জব্বার (পিতা আব্দুল বেপারী, আয়লা), আব্দুল মজিদ (পিতা শরাফত আলী, আয়লা), মাে. সিরাজ (পিতা সাবিদ আলী, বারবাত্তা), খুশিদ মিয়া (পিতা ইসমাইল, ফতেরপুর), শওকত আলী (পিতা আব্বাস আলী, ফতেরপুর), কভু মিয়া (পিতা মাে. ইব্রাহিম, কিরাটন), আব্দুল গণি (পিতা আব্দুল জব্বার, কিরাটন), আব্দুল গফুর (পিতা ওয়াফিজ, কিরাটন), মাবুদ আলী (পিতা ছমেদ আলী, কিরাটন), আপ্তাবউদ্দিন (পিতা শরাফত তালুকদার, বিদ্যানগর) এবং হাছু মিয়া (পিতা মরছব আলী, কিরাটন)।
আয়লা-বিদ্যানগর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেনকুতুব উদ্দিন, মাে. বিল্লাল মিয়া, মাে. হেলাল উদ্দিন, হাবিবুর রহমান, আ. জব্বার, ফজলু মিয়া, মাে. আবু ছিদ্দিক, ফালু মিয়া প্রমুখ। [সালেহ আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড