You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর বিক্রম আমিন আহমেদ চৌধুরী

আমিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম (১৯৪৬-২০১৩) বীর মুক্তিযােদ্ধা, জেড-ফোর্সের অধীন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডার এবং স্বাধীনতােত্তর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল। তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বর্তমান ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুলতান আহমেদ চৌধুরী এবং মাতার নাম আজিজুন্নেসা। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি পুলিশ সার্ভিসে তার পিতার চাকরির সুবাদে পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহ শহরে তাঁর শৈশব ও কৈশাের কেটেছে। ময়মনসিংহ থেকে মেট্রিক (এসএসসি) পাস করার পর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পাস করার পর তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমােহন। কলেজে বিএসসি-তে ভর্তি হন। বিএসসি শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৬৫ সালের ২৭শে নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যােগ দেন। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (কাকুল) থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ট্রেনিং সমাপ্ত করে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পােস্টিং পান।
আমিন আহমেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (East Bengal Regimental Centre, EBRC)-এ প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে গণ-আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে তিনি গােপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটরের অধীনে ডিউটি করেন। এ সুবাদে তিনি পাকিস্তানিদের মনােভাব বুঝতে পারেন। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেবার পর তা আরাে স্পষ্ট হয়। মার্চ মাসের শুরু থেকেই চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সামরিক অফিসারগণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যান। পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা আমিন আহমেদ চৌধুরীর বিদ্রোহী মনােভাব আঁচ করতে পেরে তাঁকে ২৫শে মার্চ হেলিকপ্টারে করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসে।
২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। তারা ঐ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কয়েকজন অফিসারসহ ইবিআরসিতে কয়েকশ বাঙালি সেনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। আমিন আহমেদ চৌধুরী এ খবর জানতে পেরে ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন।
ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী ১১নং সেক্টরের অধীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলাে সফল অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে ৭ই জুলাই মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ব্রিগেড আকারে ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হলে তিনি দক্ষতার সঙ্গে এ ফোর্সের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নির্দেশনা, পরিকল্পনা ও সার্বিক দায়িত্বে ৪ঠা আগস্ট বর্তমান শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী বিওপি (Border Out Post)-তে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ বিওপিতে পাকিস্তানি এক কোম্পানি সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য মােতায়েন ছিল। দুই কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী নকশী বিওপিতে আক্রমণ পরিচালনা করেন। মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে মাত্র ২০ জন মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন নিয়মিত বাহিনীর (১০ জন সামরিক বাহিনী, ৮ জন ইপিআর এবং ২ জন পুলিশ), বাকি সবাই ছিলেন এক বা দুই সপ্তাহের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণবাহিনীর সদস্য। নির্ধারিত দিনে আক্রমণ পরিচালনা করার পূর্বে তিনি তিনদিন যাবৎ সম্পূর্ণ বিওপি রেকি করেন। পরিকল্পনামতে আমিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩রা আগস্ট মুক্তিবাহিনী। রাত ১২টার সময় এসেম্বলি এরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে এফইউপি (Forming Up Place)-তে পৌছে ৪ঠা আগস্ট গভীর রাতে চূড়ান্তভাবে পজিশন নেন। তার ওয়ারলেসের মাধ্যমে নির্দেশ দেবার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠে। তবে ঘটনাক্রমে যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই নিজেদের ছােড়া আর্টিলারির কয়েকটি গােলা এসে পড়ে এফইউপিতে। এর ফলে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হন। এ-সময় শত্রুসেনারাও তাদের আক্রমণ তীব্রতর করে। শত্রুসেনাদের ছােড়া একটি শেলের আঘাতে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ আহত হলে যুদ্ধের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে; ফলে মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। সহযােদ্ধাদের মনােবল চাঙ্গা করতে আহত অবস্থায় আমিন আহমেদ চৌধুরী বীরত্বের সঙ্গে শত্রুদের বাংকারের পাঁচ গজ সীমানার মধ্যে পৌছে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ জোরদার করে নকশী বিওপি ধ্বংস করে ফেলেন। এ-যুদ্ধে ৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ২৩ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্বের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বর্তমান মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসে মিলিটারি এটাশে; ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক; ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টি বাের্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সেনা কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২য় (১৯৮৫), ৬ষ্ঠ (১৯৯৩) ও ১১শ (২০১০) সাফ গেমস আয়ােজনে তিনি মূল। সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সমর-নীতি, সমর| কৌশল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি লেখালেখি করতেন। ২০১৩ সালের ১৯শে এপ্রিল এ বীর মুক্তিযােদ্ধা ইন্তেকাল করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সৈয়দা লতিফা আমিন। এ দম্পতির ২টি পুত্র সন্তান রয়েছে। সােজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!