You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক আমির হােসেন - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক আমির হােসেন

আমির হােসেন, বীর প্রতীক (১৯৫৩-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বাবর আলী এবং মাতার নাম তসিরন নেছা। আর্থিক অনটনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর আমির হােসেনের লেখাপড়া আর খুব বেশি হয়নি। তাঁকে অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হয়। বাবার হাত ধরে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি গ্রামে গ্রামে সরিষার তেল বিক্রি করতেন। বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরার জন্য সহজেই তিনি দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হতেন। এর মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের শাসন-শােষণ থেকে বাঙালির মুক্তির বিষয়টি বুঝতে পারেন। ক্রমেই তিনি নিজের অজান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে যান।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং নৌকা মার্কাকে ভালােবেসে একজন সক্রিয় কর্মীর ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভােটে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে দেশের অন্যদের মতাে আমির হােসেনও বিক্ষুব্ধ হন। এ-সময় সমগ্র দেশের ন্যায় নবাবগঞ্জেও চলতে থাকে আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি। পরিবারের সকলের অজান্তে আমির হােসেনও এর সঙ্গে যুক্ত হন।
২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনীর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর ঢাকা থেকে লক্ষ-লক্ষ মানুষ নবাবগঞ্জে আশ্রয় নেয়। আমির হােসেন অন্যদের সঙ্গে এসব মানুষের খাদ্য, আশ্রয় এবং নিরাপদে বাড়ি ফেরার বিষয়ে সহায়তা দেন। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে তিনি স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতে গিয়ে ৩নং সেক্টরে নাম অন্তর্ভুক্ত করে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে এ সেক্টরে কিছুদিন যুদ্ধ করে অনুমতি নিয়ে নিজ এলাকায় চলে আসেন। এলাকায় তিনি স্থানীয় হালিম বাহিনীতে নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আব্দুল হালিম চৌধুরী নিজ উদ্যোগে তাঁর এ বাহিনী গঠন করেন। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলায় এ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স ছিল।
৪ঠা নভেম্বর আমির হােসেন কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাসহ একটি ক্যাম্পে দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলেন। এ সময় খবর আসে পার্শ্ববর্তী সামসাবাদ ক্যাম্পে হানাদার বাহিনী আক্রমণ করেছে। আমির হােসেন এবং তাঁর সহযােদ্ধারা প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত এ গ্রামে গিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। উভয় পক্ষের যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকারহতাহত হয়। হানাদার বাহিনীর সংখ্যা এবং ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযােদ্ধাদের কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আব্দুল বেপারীর বাড়ির পাশের একটি কবরস্থানে পজিশন নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন আমির হােসেন। এক পর্যায়ে শত্রুর গুলিতে একজন সহযােদ্ধা শহীদ হলে আমির হােসেন ক্রলিং করে তাঁকে উদ্ধার করতে যান। এ-সময় পাকসেনারা আমির হােসেনের অবস্থান জানতে পেরে তাকে লক্ষ করে গুলি ছােড়ে। কয়েকটি গুলি আমির হােসেনের শরীরে বিদ্ধ হয়। গুরুতর আহত হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহযােদ্ধারা গ্রামবাসীর সহায়তায় তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথেই তার মৃত্যু হয়। তাঁকে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। মুত্যুকালে আমির হােসেন স্ত্রী রাহেলা খাতুন এবং ১ কন্যা সন্তান রেখে যান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শহীদ আমির হােসেন-কে ‘বীর প্রতীক’ (মরণােত্তর) খেতাবে ভূষিত করা হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড