You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর উত্তম আব্দুস সালেক চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

বীর উত্তম আব্দুস সালেক চৌধুরী

আব্দুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম (১৯৪৬-১৯৭২) বীর মুক্তিযােদ্ধা ও সাব-সেক্টর কমান্ডার। মেজর আব্দুস সালেক চৌধুরী ১৯৪৬ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম এ আর চৌধুরী ও মাতার নাম সায়মা খাতুন। তিনি সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুলস্থ পাকিস্তান। মিলিটারি একাডেমিতে যােগদান করেন। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে কমিশন প্রাপ্তির পর ২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে যােগ দেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি কয়েকজন সহকর্মীসহ পালিয়ে ভারতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। প্রাথমিকভাবে তাঁকে ২নং সেক্টরের সালদা নদী সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। জুন মাসে চতুর্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানির একটি প্লাটুন নিয়ে তিনি সালদা নদীতে পাকিস্তানি শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে শত্রুপক্ষের জেসিও-সহ ৩২ জন হতাহত হয়। ঐ সময়ে তিনি সালদা নদী ও নয়নপুরের মধ্যে পাকসেনাদের যােগাযােগের রাস্তায় মাইন পুঁতে ১০ জন শত্রুসেনাকে হত্যা ও অনেককে আহত করেন। ৯ই জুলাই কর্নেল গাফফার ও তিনি মন্দভাগে মুক্তিযােদ্ধাদের নিজস্ব গােলন্দাজ বাহিনী মুজিব ব্যাটারির সহায়তায় শত্রুসৈন্যদের ওপর আক্রমণ করেন। এতে ২ জন শত্রুসেনা নিহত ও ১১ জন আহত হয়। জুলাই মাসে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। গেরহুলা ও আকাবাড়ীতে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে পাকবাহিনী আক্রমণ চালালে পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা একটি এমিনিউনিশন ও ১টি রেশন স্টোর উড়িয়ে দেন। এতে পাকবাহিনীর কয়েকজন সেনাসদস্য নিহত ও ২ জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম গােলন্দাজ বাহিনী মুজিব ব্যাটারি সক্রিয় হওয়ায় জুলাই মাস থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে এ সাবসেক্টরের আক্রমণগুলি সফল হতে থাকে। ২৬শে জুলাই মনােরা সেতুর নিকট পাকবাহিনীর ওপর মুক্তিযােদ্ধারা মেজর সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে মর্টারসহ আক্রমণ করেন। এতে ৪ জন শত্রুসৈন্য নিহত ও অনেকে আহত হয়। একইভাবে একটি কমান্ডাে প্লাটুন ও একটি ডেমােলিশন দল ২৮শে জুলাই হরিমঙ্গলের রেলসেতুটি উড়িয়ে দেয়। আগরতলার কাঠামােড়ায় মেজর সালেকের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি শত্রুসৈন্যদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। নদীপথে গােপন একটি সরবরাহ রুটে এম্বুশ পেতে মুক্তিযােদ্ধারা পাকসেনাদের সরবরাহ নৌকা আক্রমণ করে এর ৫টি ডুবিয়ে দেন। ৬০-৭০ জন পাকসেনা নদীতে ডুবে মারা যায়। এক সময়ে মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বাধীন চার্লি ও আলফা কোম্পানির চাপ সহ্য করতে না পেরে পাকসেনারা মন্দভাগ, লক্ষ্মীপুর, সাইততলা ইত্যাদি ঘাঁটি থেকে পিছিয়ে গিয়ে চাদুলা, পানছড়া ও সেনেরহাটে নতুন ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৩ই অক্টোবর পাকহানাদাররা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানগুলােতে তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে টিকতে পেরে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে ৪৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এ পর্যায়ে কর্নেল গাফফারের নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি এবং হেডকোয়ার্টার্সের কিছু সৈন্য নিয়ে চতুর্থ বেঙ্গল তৈরি করে বাহিনীর পুনর্বিন্যাস করা হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের আলফা ও ব্রাভাে কোম্পানির অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে দশম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মেজর সালেককে এর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এছাড়া চতুর্থ, নবম ও দশম রেজিমেন্টকে নিয়ে ‘কে’ ফোর্স নামে একটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। মুজিব ব্যাটারিকে ‘কে’ ফোর্সের সঙ্গে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ‘কে’ ফোর্স এবং ২নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব উভয়ই মেজর খালেদ মােশাররফের ওপর দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় খালেদের অবর্তমানে দুটি ফোর্স বিভক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়কত্ব করবেন মেজর সালেক এবং ২নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব করবেন কর্নেল হায়দার। ডিসেম্বরে ‘কে’ ফোর্স ছাগলনাইয়া ও ফেনীর উপকণ্ঠে পাকসেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে পশ্চাদপসরণ করে। এ-সময় খালেদ মােশাররফ আহত হওয়ায় মেজর সালেক ‘কে’ ফোর্সের নেতৃত্ব নেন। ১৬ই ডিসেম্বর এক ডিভিশন পাকসেনা ‘কে’ ফোর্সের নিকট আত্মসমর্পণ করে। সালদা নদী সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে ‘কে’ ফোর্সের নেতৃত্ব দেয়া পর্যন্ত মেজর সালেকের ভূমিকা ছিল খুবই গৌরবােজ্জ্বল ও সাহসিকতাপূর্ণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীকে ‘বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭২ সালে এক সড়ক দূর্ঘটনায় এ বীর মুক্তিযােদ্ধার মৃত্যু হয়। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড