আমতলী উপজেলা
আমতলী উপজেলা (বরগুনা) ব্রিটিশ আমল থেকেই সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র ছিল। এ কারণে এখানকার মানুষ ছিল রাজনীতি-সচেতন। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি আন্দোলন-সংগ্রামে আমতলীবাসীর গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এখানকার মানুষ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের শুরুতেই বােঝা যাচ্ছিল যে, পাকিস্তানি শাসকরা বাংলার নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগএর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযােগ আন্দোলন। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পর দেশের সর্বত্র অসহযােগ আন্দোলন আরাে জোরদার হয়। আমতলীর জনগণও তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। প্রতিদিন ছাত্র-জনতার মিটিং-মিছিল চলতে থাকে। ১৫ই মার্চ আমতলীতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ বি এম আসমত আলী আকন এর সভাপতি এবং নাসির উদ্দিন তালুকদার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন- আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস, নুরুল ইসলাম তালুকদার পাশা, আবদুল মন্নান মৃধা, মঈন উদ্দিন তালুকদার, নিজাম উদ্দিন তালুকদার, আবদুল হাই মাস্টার, মাহবুব আলম তালুকদার ঝন্টু, আমির হােসেন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, জি এম দেলওয়ার হােসেন, দেওয়ান মজিবর রহমান, শাহজাহান কবির, আবদুল আজিজ মিয়া, শাহ জালাল খান, আবদুল বারেক, আবদুল গনি, আনসারুল আলম, মােতালেব মাস্টার, হযরত আলী জোমাদ্দার, অংথা মাস্টার, অংকুজা মাস্টার এবং নিতাই পােদ্দার। আমতলীর আওয়ামী লীগ অফিসে পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। সংগ্রাম পরিষদ মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতার পক্ষে উজ্জীবিত করতে থাকে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের পরিবর্তে পূর্ব বাংলায় পতাকা দিবস পালিত হয়। সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানাে হয়। আমতলী থানায়ও নূরজাহান ক্লাব প্রাঙ্গণে পতাকা উত্তোলন করেন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য জি এম দেলওয়ার হােসেন। আমতলীর কৃতী সন্তান হাবিলদার এম এ বারিক খান ঢাকায় ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স অফিস ভবনে পতাকা উত্তোলন করেন।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি নরপিশাচরা নিরীহ বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালালে আমতলীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এম ইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাে. বজলুল করিম খান, জি এম দেলওয়ার হােসেন এবং আবদুল বারেক ভূমি অফিস মাঠে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তীকালে আরপাঙ্গাশিয়ার সীড স্টোর, বাইনবুনিয়ার খােরশেদ আলম মিয়া (সেনাবাহিনীর সদস্য)-র বাড়ি, ছকিনার মােতালেব মাস্টারের বাড়ি এবং আগাঠাকুর পাড়ার থমরাউ বাবুর বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কেউ-কেউ প্রশিক্ষণের জন্য বামনার বুকাবুনিয়া ও ভারতে যান। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন নাদের পারভেজ পটুয়াখালী থেকে আমতলীতে এলে প্রশিক্ষণ। কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে।
এদিকে সর্বস্তরের জনগণকে সামরিক প্রশিক্ষণ দানের উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন আমতলী থানার পুলিশ সদস্য আবদুল বারেক এবং এম ইউ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক বজলুর রহমান। তরুণদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন জি এম দেলওয়ার হােসেন। মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বিশেষ দলের প্রশিক্ষক ছিলেন খােরশেদ আলম। স্বল্পমেয়াদি এ প্রশিক্ষণ শেষ করে অনেকেই যুদ্ধে চলে যান। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন- আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস, নুরুল ইসলাম তালুকদার পাশা, জি এম দেলওয়ার হােসেন, মঈন উদ্দিন তালুকদার, শাহ জালাল খান এবং আতাউল্লাহ। জি এম দেলওয়ার ও শাহ জালাল খান ব্যতীত বাকি সবাই সুন্দরবনে মেজর জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে যােগ দেন এবং ঐ অঞ্চলের হেডকোয়ার্টার্স ও ট্রেনিং সেন্টার বুকাবুনিয়ায় (বামনা উপজেলা) অবস্থান নেন। এদিকে জি এম দেলওয়ার ও শাহ জালাল খান উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান এবং প্রশিক্ষণশেষে একত্রে বাংলাদেশে আসেন। এসময় আমতলী-কলাপাড়া অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মেজর (অব.) হাতেম আলী। তিনি তাঁর গ্রুপ নিয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার পরিকল্পনা করেন।
সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আমতলী বন্দর (বর্তমান পৌর শহরের ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড)-এর চারদিকে পরিখা খনন করে বন্দরকে সুরক্ষিত করা হয়। মে মাসের শেষদিকে আফাজ উদ্দিন বিশ্বাসের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসহ আরাে ৩০-৪০ জনকে নিয়ে একটি বেসামরিক প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি হন আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস এবং সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মজিবর রহমান। আরপাঙ্গাশিয়া বাজারের পশ্চিম পাশে সীড স্টোরে এর অফিস করা হয়। পরে এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
আমতলী উপজেলা ছিল ৯নং সেক্টরের অধীন। এ সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর এম এ জলিল। যুদ্ধ চলাকালে পটুয়াখালীকে সাবসেক্টর করে কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমামকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়। পটুয়াখালীকে ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত করে আমতলী-কলাপাড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় সুবেদার হাতেম আলীকে। তিনি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস, নুরুল ইসলাম তালুকদার পাশা, মঈন উদ্দিন তালুকদার, আসমত আলী কেরানী, জামাল মাস্টার, আবদুল মােতালেব মাস্টার প্রমুখের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জনের একটি কমিটি গঠন করেন।
আমতলী উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস, নিজাম উদ্দিন আহমেদ তালুকদার (পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ সদস্য), জি এম দেলওয়ার হােসেন, মঈন উদ্দিন তালুকদার, শাহ জালাল খান, মতলেব মাস্টার, খােরশেদ আলম এবং গাজী আনােয়ার হােসেন। গাজী আনােয়ার হােসেন মুক্তিযােদ্ধাদের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দেওয়ান মজিবর রহমান ও আপতের উদ্দিন ডাক্তার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করতেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী আমতলী উপজেলায় অনুপ্রবেশ এবং থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
আমতলী উপজেলার স্বাধীনতাবিরােধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলাে- ইসমাইল হােসেন ওরফে নশা তালুকদার (কুকুয়া ইউনিয়ন), নুর মােহাম্মদ আকন (চাওড়া ইউনিয়ন), রাজাকার মুছাই প্যাদা (আমতলী সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিমে আমতলী গ্রাম), আ. খালেক ও চান মিয়া প্যাদা (আমতলী বন্দর), আমতলী থানার ওসি রইস উদ্দিন ভূঁইয়া, সিআই সিকান্দার আনােয়ার, সেকেন্ড অফিসার তাহের (এসআই) প্রমুখ। এরা স্বাধীনতাবিরােধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল। হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযােগী মুছাই প্যাদাকে পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধারা হত্যা করেন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমতলী বন্দরের আনােয়ার হােসেন তালুকদারকে চেয়ারম্যান এবং আ. আজিজকে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
ক্যাপ্টেন নাদের পারভেজের নেতৃত্বে পাকসেনারা বেশ কয়েকবার গানবােট নিয়ে আমতলী থানায় আসে এবং ওসি রইস উদ্দিন ভূঁইয়াকে সঙ্গে নিয়ে বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। কিন্তু কোনােবারেই তারা সফল হতে পারেনি। একবার তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ বি এম আসমত আলী আকন এবং তাঁর সঙ্গীদের ওপর হামলা করে। তখন তারা পুজাখােলা গ্রামের মােহাম্মদ হাওলাদারের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযােদ্ধারা এ হামলাও ব্যর্থ করে দেন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকসেনারা কুকুয়া হাট এলাকার ঋষিবাড়িতে ঢুকে নারীনির্যাতন চালায়। চাওড়া ইউনিয়নের এম এ বারিক খান (পিতা আলী আজিম খান, বৈঠকাঠা) ইপিআর-এর হাবিলদার ছিলেন। ২৭শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স-এর বাসভবন থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার আর কোনাে সন্ধান পাওয়া যায়নি। জুন মাসে চট্টগ্রামের রাউজান থানায় শহীদ হন আমতলীর কৃতী সন্তান নাসির উদ্দিন তালুকদার (হলদিয়া ইউনিয়ন)। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী যখন আমতলী থানা দখল করে, তখন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন এ বি সিদ্দিকী। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। তাই শত্রুপক্ষ কবলিত থেকেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতেন। ২রা জুন বাধ্য হয়ে তিনি স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি বজলুর রহমান, শরৎ চ্যাটার্জী, অক্ষয় মজুমদার এবং পীযূষ কান্তি মজুমদারকে গ্রেপ্তার করেন। হানাদার বাহিনী তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করে। পরে অবশ্য এ বি সিদ্দিকীর রিপাের্টের ভিত্তিতেই তাঁদের মুক্তি দেয়া হয়।
যুদ্ধের পুরােটা সময় আমতলী বন্দর ব্যতীত উপজেলার বাকি অঞ্চল ছিল মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তাই এ উপজেলায় আমতলী থানা দখলের যুদ্ধ ব্যতীত উল্লেখযােগ্য আর কোনাে যুদ্ধ হয়নি। ১৩ই ডিসেম্বর এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে থানায় অবস্থানরত ওসি রইছ উদ্দিন ভূঁইয়া, সিআই সিকান্দার আনােয়ার, পুলিশ, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে। পুলিশের গুলিতে বেপারি নৌকার অজ্ঞাতনামা একজন মাঝি নিহত হন। এরপর মুক্তিযােদ্ধা আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস থানা চত্বরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে আমতলীকে হানাদারমুক্ত ঘােষণা করেন।
আমতলী উপজেলার মুক্তিযােদ্ধা নগেন ধুপি (পিতা গােপাল চন্দ্র ধুপি, কৃষ্ণনগর; কৃষক) নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে পটুয়াখালী জেলার বিঘাই ইউনিয়নের ফুলঝুরি গ্রামে রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ২০১৪ সালে আমতলী। উপজেলা পরিষদ চত্বরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [এ কে এম খায়রুল বাশার বুলবুল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড