আমবাগান বধ্যভূমি ও গণকবর
আমবাগান বধ্যভূমি ও গণকবর (চট্টগ্রাম মহানগর) চট্টগ্রাম রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এলাকায় অবস্থিত। এলাকাটি ছিল অবাঙালি বিহারি অধ্যুষিত। ওয়ার্কশপে কর্মরতদের বেশির ভাগ ছিল অবাঙালি। চাকরির কারণে তারা ওয়ার্কশপের আশেপাশেই থাকত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা মনে করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে। সে-কারণে তারা বাঙালিদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ শুরু করে। আমবাগান ও টাইগারপাস এলাকা ছিল বিহারি আনােয়ার খানের নিয়ন্ত্রণে। সে আরাে কয়েকজন বিহারি যুবক নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির দায়িত্ব ছিল এলাকার বাঙালিদের ওপর নজরদারি করা। মানুষজন, বিশেষত বিহারিরা তাকে ‘মেজর সাহাব’ বলে ডাকত। সে কোমরের দুপাশে দুটি রিভলবার নিয়ে চলত। তার চারদিকে সব সময় পাহারা থাকত। প্রতিদিন সকালে সে ওয়ার্কশপের বড় কর্মকর্তাদের অফিস দখল করে সেখানে বসে তার কর্মপরিকল্পনা করত। তার নির্দেশেই প্রশাসন পরিচালিত হতাে, যদিও সে রেলের কোনাে চাকুরে ছিল না। সে ছিল ঝাউতলা বাজারের একজন কসাই।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর বিহারিরা একটু দমে যায়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর কসাই আনােয়ারকে ঝাউতলা বাজারে খুব একটা দেখা যেত না। কিন্তু ১লা এপ্রিল পাকসেনারা চট্টগ্রাম শহর দখল করে নেয়ার পর বিহারিরা আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আনােয়ারকে প্রকাশ্যে দেখা যায়। সে বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে এখানে-সেখানে যাতায়াত শুরু করে। একদিন সে ঝাউতলা বাজারে সরদার বাহাদুর নগরের মােসলেম খান নামে একজন আওয়ামী লীগসমর্থককে পেয়ে তার মাংসের দোকানের ধামা (ধারালাে কাটারি) দিয়ে প্রকাশ্যে কোপাতে থাকে। মােসলেম আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। কসাই আনােয়ারের ভয়ে কেউ তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। তিনি সেখানেই মারা যান। সেদিন থেকেই আনােয়ার বিহারিদের নেতায় পরিণত হয়।
ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গুরুত্ব দিত বলে তার প্রভাব আরাে বেড়ে যায়। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, তার নির্দেশে অফিসের বাঙালি কর্মকর্তারা তার অফিস ঝাড় দিতে পর্যন্ত বাধ্য হতেন। এ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রায় সকল বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীই এক সময় অফিস ছেড়ে পালিয়ে যান। সেই থেকে ঐ এলাকায় আনােয়ারের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আশপাশের বিহারি এলাকাগুলাের দুবৃত্তরাও তার সঙ্গে যােগ দেয়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের আড্ডা চলত। মাঝে-মধ্যে তার আডডায় হানাদারদের কেউ-কেউ আসত।
কসাই আনােয়ার রেলওয়ে ওয়ার্কশপের অভ্যন্তরে একটি নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করেছিল। সেখানে টাইগারপাস বখতেয়ার নৌঘাঁটি থেকে নৌবাহিনীর সদস্যরা এসে বাঙালিদের নির্যাতন করার কৌশল শিখিয়ে দিত।
আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা সামনের শাহজাহান মাঠে বিহারিদের প্রশিক্ষণ দিত। পাকিস্তানি সৈন্যরাও মাঝে-মধ্যে প্রশিক্ষণ দিতে আসত। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ওপর আনােয়ার একটি বালাখানা গড়ে তুলেছিল। সেখানে সে বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করত। অসংখ্য নারী সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আনােয়ার তার বালাখানায় মদের আসর বসাত। তার ছিল ৫০-৬০ জনের একটি গােয়েন্দা বাহিনী। তারা আমবাগান, ঝাউতলা, টাইগারপাস ও সর্দার বাহাদুর নগর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। অসংখ্য বাঙালিকে তারা হত্যা করেছিল। প্রথম দিকে সে এবং তার বাহিনী মানুষ হত্যা করে পাহাড়ে নিয়ে পুঁতে ফেলত কিংবা আমবাগান রেল লাইনের পাশে বিশাল এক পানির ট্যাংকে ফেলে দিত। পরে লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সেগুলাে রেলের ট্রলিতে করে নিয়ে যেত ফয়’স লেক বধ্যভূমিতে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আনােয়ারের টেবিলে জমা হতাে টাকার স্থূপ। বিশেষ একটি বাক্সে জমা হতাে স্বর্ণ। এভাবে ২৫ বছর বয়সী আনােয়ার রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। বহু ঘরবাড়িও সে দখল করে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে তার নেতৃত্বে বিহারিরা শাহজাহান মাঠ থেকে মিছিল বের করে। মিছিলে আনােয়ার গলায় মালা পরে খােলা জিপে এলাকা প্রদক্ষিণ করে। কয়েকশ বিহারি যুবক তাকে গার্ডঅব-অনার প্রদান করে।
রমজান মাসের (অক্টোবর-নভেম্বর) এক রাতে মুক্তিযােদ্ধা লােকমান গ্রুপ আনােয়ারের বালাখানা আক্রমণ করে। এতে ৪-৫ জন দোসরসহ আনােয়ার নিহত হয়। এ ঘটনার পর এলাকার বিহারিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তাদের অন্যান্য নেতারা আত্মগােপনে চলে যায়। বিভিন্ন কলােনি থেকে বিহারিদের আনাগােনা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমবাগান এলাকার বিহারিরা ভয়ে হালিশহর, ফিরােজশাহ কলােনি, শেরশাহ কলােনি, কৈবল্যধাম প্রভৃতি এলাকায় চলে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধা ও জনতা আমবাগান রেললাইনের পাশের পানির ট্যাংক থেকে অসংখ্য দেহাবশেষ উদ্ধার করে। সেই থেকে স্থানীয় লােকেরা এই ট্যাংককে বলত ‘৭১-এর গণকবর’। [সাখাওয়াত হােসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড