You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৯ই নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৩, ২৩শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ইসরাইলের গোঁয়ার্তুমী, শান্তি আর কত দূর?

রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধবিরতি সম্পর্কিত রিপোর্টে অভিযোগ করেছেন, অক্টোবরের যুদ্ধ বিরতি রেখায় সৈন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নির্দেশ দিয়ে স্বস্তি পরিষদে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, ইসরাইল তা ক্রমাগত অমান্য করে চলেছে। মহাসচিবের রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রসংঘের তদারকি বাহিনীর অধিনায়ক ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দায়ানের সঙ্গে একবার নয়, দু’দুবার কথা বলেছেন, কিন্তু এখনো তেল আবিবের কাছ থেকে কোন সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। ঐদিকে মিসর সরকারীভাবে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কাছে প্রতিবাদ জানাচ্ছে যে, ইসরাইল জেনেভা কনভেনশন সংঘন করে সুয়েজ খাল এলাকায় বেসামরিক জনগণের উপর বোমবর্ষণ করে চলেছে। তেল উৎপাদনকারী দশটি আরব দেশ তেল রপ্তানীর ব্যাপারে যে মারণাঘাত হেনেছে, তাতে বিশ্বব্যাপী তেল সংকটের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ‍উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমাবস্থায় আরবদের তেলাস্ত্রের প্রতি তেমন গা করেনি। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের তেল ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বাঁচোয়া নেই তাও দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। দেখা যাচ্ছে, নিক্সন সরকার তেল সংকটের কবলে পড়ে রীতিমতো খাবি খেতে শুরু করেছে। আরব দেশগুলো তেল সরবরাহ বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় সাধারণ বাজারভুক্ত দেশগুলোর যৌথ ঘোষণানুযায়ী বোঝা যাচ্ছে, আরবদের তেল ছাড়া শিল্পোন্নত এবং শীতপ্রধান দেশগুলোর অবস্থা নিদারুণ কাহিল হয়ে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে ইসরাইলকে যেসব দেশ মদদ জুগিয়েছে, সেই সব দেশে স্বাভাবিক কারণেই আরবদেশগুলো তেল সরবরাহ করবে না। ফলে পাশ্চাত্যের আলোকোজ্জ্বল শহরগুলোতে তেলের অভাবে নিষ্প্রদীপ পরিস্থিতির উদ্রেক হবে। তাই অবস্থা যখন ত্রাহি মধুসূদন, তখন পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুখ খুলতে শুরু করেছে। এখন অনেক দেশের মুখেই শোনা যাচ্ছে, ইসরাইলকে সাতষট্টি সালের স্বস্তি পরিষদ প্রস্তাব পুরোপুরি মেনে নিয়ে দখল করা আরব এলাকা থেকে সরে আসতে হবে। এটাই হক কথা। কিন্তু এই হক কথা উচ্চারণের ব্যাপারে মার্কিনী তাঁবেদার ইউরোপীয় দেশগুলো এতোদিন টু-শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি একথা তো আমরা সবাই অবগত রয়েছি। তেল সংকটে নিমজ্জমান দেশগুলো এখন তাই হাঁক ছাড়ছে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের একটা সুরাহা হওয়া দরকার, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা আর বেশী দিন ঝুলিয়ে রাখা উচিত নয়। কিন্তু এসব সময়োচিত চটকদার কথাবার্তা বলে তো আর মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সত্যিকার কোনো মীমাংসা হবেনা। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাম্রাজ্যলিপ্সু ইসরাইলের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদতের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিতে হয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, আমি মনে করি, আমরা শান্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট সাদত ও ডঃ কিসিঞ্জারের সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, আমি ওঁর সাথে একমত। জানা গেছে, অচিরকালের মধ্যেই নাকি মিসর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক সংস্থাপিত হচ্ছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক, কিন্তু তাতে কি মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার অবসান হবে? আরবদেশগুলোর সিদ্ধান্তানুযায়ী তেল সরবরাহ বন্ধের জন্যে গোটা বিশ্বই আজ চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। আরব দেশগুলোও ভেবে-চিন্তেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। হয়তো এতে সমস্যার সমাধান হবে, নয়তো এতে বিশ্বে রাসায়নিক ও জীবাণু যু্দ্ধের সূচনা হতে পারে। জ্বালানী তেলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্য সংকটের নিরসন চাইছে। এমতাবস্থায় ইসরাইলী গোঁয়ার্তুমীকে বাগ মানানোর দায়িত্ব বর্তেছে মুরুব্বী আমেরিকার উপর। কাজেই বিশ্বের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই সর্বাগ্রে তৎপর হতে হবে। জ্বালানী সংকটের আবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবর্তিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরাইলের আগ্রাসী মনোভাব দূর করার জন্যে যদি উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবেই মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিবারিত হতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী তেল সংকটের মতো মারাত্মক পরিস্থিতিরও অবসান সহজ হবে বলে আমরা মনে করি। এতোদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে তেমন গা করেনি, এখন তেলাস্ত্রের আঘাতে হয়তো তারও টনক নড়া স্বাভাবিক। ইউরোপীয় দেশগুলো ইতিমধ্যেই নড়েচড়ে বসেছে। এমতাবস্থায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সনাতনী নীতি পাল্টানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

অশুভ তৎপরতাকে রুখতে হবে

রাজশাহীর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা আগের মতোই বিরাজ করছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ। আসন্ন আমন ধান কাটার মৌসুমে কৃষকরা ধান ঘরে তুলতে পারবে কি না সে বিষয়ে শংকিত। সন্ত্রাসবাদী কথিত নকশালীরা জমির ধান ভূমিহীন এবং গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে বলে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে এবং এতে তারা বিপুল সমর্থন পাচ্ছে। এদের দাপট ও কর্মতৎপরতা এতই ব্যাপক হয়েছে যে জমির মালিকরা নিজেদের জমিতে ভিড়তে পারছেন না। রাজশাহী জেলার বিভিন্ন থানা ফাঁড়ি বিশেষ করে সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত থানাগুলো থেকে অস্ত্র লুট, পুলিশ হত্যা, থানা আক্রমণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতা, রিলিফ চেয়ারম্যান এবং নিরপরাধ নিরীহ জনগণ তাদের হত্যার শিকারে পরিণত হচ্ছেন। শুধু রাতের আঁধারে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকেও তাদের অশুভ কর্মতৎপরতা নির্বিঘ্নে চলছে বলে খবরে প্রকাশ।
সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা নতুন নয়। বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তরকালে এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজশাহী জেলার বিভিন্ন এলাকা সহ দেশের অন্যান্য স্থান যেমন চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকা, সুন্দরবনের অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন স্থানে এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিভিন্ন সময়ে খবর বেরিয়েছে। জনগণ নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বলে তারা সন্ত্রাসবাদীদের খবর পুলিশের কাছে দিতে নারাজ বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সুতরাং এমতাবস্থায় আমরা মনে করি, সন্ত্রাসবাদীদের অশুভ কর্মতৎপরতা দৃঢ়হস্তে দমন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সে এলাকার জনগণের নিরাপত্তাও ফিরিয়ে এনে সন্ত্রাসবাদীদের অশুভ কর্মতৎপরতার কুফল সম্পর্কে জনগণকে পুরোপুরি অবহিত করে মানসিক দিক থেকেও তাদেরকে উজ্জীবিত করে তুলতে হবে।

স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচন প্রসঙ্গে

আগামী ১৭ই ডিসেম্বর থেকে ২৭শে ডিসেম্বর পর্যন্ত দশদিন ব্যাপী বাংলাদেশের সর্বত্র ইউনিয়ন কাউন্সিল, টাউন কাউন্সিল ও পৌরসভা সহ বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাইশ মাস বয়স্ক স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে এটাই প্রথম স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচন। উল্লেখযোগ্য যে, নয় বছর আগে পাকিস্তানী আমলে আইয়ুব খানের জমানায় সর্বশেষ স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। অবশ্য তা ছিলো নির্বাচনের নামে একটি প্রহসন মাত্র। আরো উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের প্রথম সামরিক শাসন জারী হবার আগে এদেশে ইউনিয়ন বোর্ড ও পৌরসভাগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো জনগণের সরাসরি ভোটে। আইয়ুব আসার কয়েক মাস আগেও দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর্যায়ে গ্রাম বাংলায় ইউনিয়ন বোর্ডগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু আইয়ুব সামরিক শাসন জারীর মাধ্যমে সে সব কিছু বাতিল করে এবং তার নির্দেশ মোতাবেক ১৯৫৯ সালে বোর্ডের পরিবর্তে কাউন্সিল গঠন করে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে জনগণ মৌলিকদের নির্বাচন করতেন আর মৌলিকরা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, তদানীন্তন প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ এবং দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতেন। ১৯৬৪ ও ৬৫ সালে এ ব্যবস্থার সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলনে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র ও জনধিকৃত মৌলিকরা সহ আইয়ুব খাঁ সমূলে উৎপাটিত হবার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় ভিত্তিক দু’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও স্থানীয় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে ১৯৬৯-এর পর থেকেই গ্রাম বাংলায় স্থানীয় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক শূন্যতার সৃষ্টি হতে থাকে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খাঁর অবলুপ্ত মৌলিকদের দলে টানার জন্য পুনরুজ্জীবিত করে এবং এদের অধিকাংশরাই পাঞ্জাবী হানাদারদের সহযোগিতা করার জন্যে গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটি ও রাজাকার সৃষ্টি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। স্বাধীনতার পর সেই মৌলিক গণতন্ত্র সহ সব কিছু আবার বাতিল করে সরকার রিলিফ কমিটি গঠন করেন এবং রিলিফ কমিটির সদস্য ও চেয়ারম্যানদের উপর পল্লী এলাকার কিছু কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব দেন। কিন্তু রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান বা সদস্যরা কেউই জনগণের ভোটে নির্বাচিত ছিলেন না।
এহেন পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পল্লী বাংলায় ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণাও শুরু হয়ে গেছে। আশা করা যায়, সুষ্ঠুভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং গ্রামের মানুষ সঠিক ও সৎ এবং নির্ভীক লোকদের নির্বাচিত করে দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষা, স্থানীয় এলাকার আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে সঠিকভাবে বিচার বিবেচনা করবেন, সে বিশ্বাস আমাদের আছে। কেননা ন’ বছর একটা দীর্ঘ সময়। এ সময়ে তাঁরা নিশ্চয়ই উপযুক্ত লোককে চিনতে সক্ষম হয়েছেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!