You dont have javascript enabled! Please enable it!

ল্যান্স নায়েক ও যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান

আব্দুল মান্নান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৭) ল্যান্স নায়েক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর নােয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মােহাম্মদনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাে. সফি উল্লাহ এবং মাতার নাম ফয়জুন নেছা। তিনি ১৯৬৭ সালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্এ যােগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঠাকুরগাঁও ৯ নম্বর ইপিআর উইং-এর পঞ্চগড় কোম্পানি হেডকোয়ার্টার্সের আওতায় চোপড়ামারী বিওপি-তে কর্মরত ছিলেন। চাকরির সুবাদে তিনি বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযােগ পান। ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে তিনি আলােচনা করতেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতেন।
৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নানা টালবাহানা শুরু করে। এর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ গর্জে ওঠে। শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ময়দানের ভাষণ থেকে বাঙালি জাতি ভবিষ্যৎ করণীয় সম্বন্ধে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পায়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নৃশংস গণহত্যা চালালে শুরু হয় প্রতিরােধ যুদ্ধ। আব্দুল মান্নানসহ বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর সৈনিকরা চোপড়ামারী বিওপি-তে অবস্থানরত অবাঙালি ইপিআর সৈনিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা করেন। পাকবাহিনী যাতে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের দিকে অগ্রসর হতে না পারে, সেজন্য বাঙালি ইপিআর ও মুক্তিকামী জনতা দশমাইল-ভাতগাঁও এলাকায় প্রতিরােধ গড়ে তােলে। আব্দুল মান্নানও বাঙালি ইপিআরদের সঙ্গে ভাতগাঁও সেতুর পাশে অবস্থান নিয়ে প্রতিরােধে অংশ নেন। ৮ই এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে সেখানে দিনভর যুদ্ধ হয়। হানাদারদের সঙ্গে টিকতে না পেরে প্রতিরােধযােদ্ধাদের নিরাপদে সরে যেতে আব্দুল মান্নান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুজন সহযােদ্ধাসহ পিছিয়ে এসে কান্তা ফার্মের সামনে আগের রাতে খুঁড়ে রাখা বাঙ্কারে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীর ট্যাঙ্ক লক্ষ করে গুলি ছুড়তে থাকেন। তাঁদের গুলিতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে পাকবাহিনী বাঙ্কার টার্গেট করে মুহুর্মুহু গুলি ছুঁড়তে থাকে। এ সুযােগে অন্যান্য ইপিআর মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতা নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হন। এক পর্যায়ে আব্দুল মান্নানদের গােলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে তারা নিরুপায় হয়ে পড়েন। সহযােদ্ধা আব্দুস সাত্তার গুলি সংগ্রহের জন্য বাঙ্কার থেকে বের হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন এবং আব্দুল মান্নান আহত হন। ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলে আব্দুল মান্নান ও তার সহযােদ্ধা আব্দুর রহমানকে পাকসেনারা ধরে ফেলে। তাদের চোখ বেঁধে সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানাে হয়। ১৪ই এপ্রিল সন্ধায় হত্যার উদ্দেশ্যে রংপুর উপশহরের একটি দিঘির পাড়ে নিয়ে গিয়ে ধৃত অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁকেও এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। তাঁর হাতে, পায়ে ও পিঠে গুলি লাগলে তিনি পড়ে যান। মৃত ভেবে পাকসেনারা চলে যায়। কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি বেঁচে যান। তারপর তিনি অতিকষ্টে পার্শ্ববর্তী পাইলছড়া গ্রামের মওলানা রুস্তম আলীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে গােপনে তার চিকিৎসা করানাে হয়। কিছুদিন পর মওলানা রুস্তম আলী তাঁকে ভারতের তরঙ্গপুর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। সেখান থেকে কল্যাণী হাসপাতাল ও পরবর্তীতে বাগডােগড়া মিলিটারি হাসপাতালে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পুরােপুরি সুস্থ না হওয়ায় তাঁকে লখনৌ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। লখনৌ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল মান্নান বর্তমানে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম তানজিলা খাতুন। তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!