You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা বীর প্রতীক আব্দুল মালেক - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক আব্দুল মালেক

আব্দুল মালেক, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫৩) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১লা জানুয়ারি সিলেট জেলার গােলাপগঞ্জ থানার নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মজির আলী এবং মাতার নাম হারী বিবি। আব্দুল মালেক দত্তরাইল মডেল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন এবং ঢাকা দক্ষিণ মাল্টিলেটারাল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। আব্দুল মালেক ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এ চাকরির মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭০ সালের ১৯শে মে তিনি সিগনাল অপারেটর পদে ইপিআর-এ যােগ দেন। তিনি কুমিল্লার কোটবাড়িতে মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে সিগনাল বিষয়ে ঢাকার পিলখানায় প্রশিক্ষণ নেন। এ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি প্রায় এক বছর ঢাকার পিলখানায় কর্তব্যে নিয়ােজিত ছিলেন। পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ যখন বাঙালি ইপিআর সদস্যদের ওপর আক্রমণ করে, তখন আব্দুল মালেক ঢাকার পিলখানায়। ২৬শে মার্চ তিনি কৌশলে পিলখানা থেকে বের হয়ে বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। প্রায় এক মাস তিনি পাবনা, কুষ্টিয়া ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নেন।
সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলে আব্দুল মালেক ৮ নম্বর সেক্টরে যােগ দেন। তাঁর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং পরে মেজর মােহাম্মদ আবুল মঞ্জুর। এ সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ সাব-সেক্টর ছিল। এ সাব-সেক্টরের প্রধান দায়িত্ব ছিল বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকার গঠনের লক্ষ্যে সে এলাকা পাকহানাদারমুক্ত রাখা। এ সাব-সেক্টরের কার্যালয় ছিল ভারতের নদীয়ায়। এটি গঠিত হয়েছিল প্রধানত ইপিআর ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে। নদীয়া থেকে মুক্তিযােদ্ধারা এ এলায়ায় নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতেন। মুক্তিযােদ্ধারা দিনের বেলা ছদ্মবেশে এবং রাতে টহলের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন। আব্দুল মালেক ও অন্য মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতেন। এভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ৭ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা মেহেরপুরে অবস্থিত পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২৪শে নভেম্বর রাতে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল মেহেরপুরের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের সহায়তা করার জন্য ভারতীয় বাহিনীর একটি দলও ব্যাকআপে ছিল। ২৫শে নভেম্বর সকালে মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর আক্রমণ করেছে – এ খবর পেয়ে পাকবাহিনী রাস্তার দুধারের ব্যাংকারে পজিশন নেয়। এক সময় দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় ও শেল বম্বিং শুরু হয়। তীব্র যুদ্ধ চলে। এখানে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। গুলি বিনিময় ও শেল বম্বিং-এর মধ্যে দুজন পাকসেনা সামনে চলে এলে আব্দুল মালেক ও অন্য চারজন। মুক্তিযােদ্ধা তাদের অস্ত্রসহ ধরে ফেলেন। এদের নিয়ে যখন তারা ভারতীয় বাহিনীর দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পাকসেনাদের ছােড়া একটি গুলি এসে আব্দুল মালেকের পেটে লাগে। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। সহযােদ্ধারা তাঁকে কাঁধে করে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যান। তাকে প্রথমে নদীয়ার কৃষ্ণনগর হাসপাতালে এবং পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে চিকিৎসা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৬শে জানুয়ারি আব্দুল মালেক দেশে ফিরে আসেন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার আব্দুল মালেককে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (তার গেজেট নম্বর ৪৭১, খেতাবের সনদ নম্বর ২২১)।
মুক্তিযুদ্ধের পর আব্দুল মালেক বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস)-এর সিগনাল বিভাগে অপারেটর হিসেবে ঢাকার পিলখানায় যােগদান করেন। ঢাকা থেকে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে তাঁকে সিলেটে বদলি করা হয়। এখান থেকে ১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী সেক্টরে স্থানত্মরিত হন। রাজশাহী সেক্টরে নিয়ােজিত থাকলেও তিনি ঢাকায় এসে সিগনাল গ্রেড-১, গ্রেড-২, ল্যান্স নায়েক ও নায়েক এই চারটি কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি পুনরায় ঢাকায় বদলি হন। ১৯৭৮ সালে তিনি বিডিআর থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যত্ম তিনি সৌদি আরবে প্রবাসী জীবন যাপন করেন। সেখানে তিনি নিজস্ব ব্যাবসা পরিচালনা করেন। তিনি ২ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম রেহেনা শিকদার। বর্তমানে তিনি নিজের গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড