You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক আব্দুল কাদের - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক আব্দুল কাদের

আব্দুল কাদের, বীর প্রতীক (১৯৫৩-১৯৭২) বীর মুক্তিযােদ্ধা এবং ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারি স্বাধীনতাবিরােধী অবাঙালি বিহারিদের আক্রমণে ঢাকার মিরপুরে শহীদ। তিনি ১৯৫৩ সালের ২২শে নভেম্বর কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিউরা ইউনিয়নের লতিফ সিকদার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী মমতাজ উদ্দিন এবং মাতার নাম লুফুন্নেছা।
আব্দুল কাদের এসএসসি পাস করে ১৯৭১ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি এলাকার ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যান। প্রথমে কাঠালিয়া এবং পরবর্তীতে অম্পিনগরে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ২নং সেক্টরে যােগ দেন এবং ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আন্তর্ভুক্ত হন। ২নং সেক্টরে অনেকগুলাে যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দেন। এর মধ্যে চন্দ্রপুর-লাতুমুড়া যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ২২শে নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার রেলস্টেশন থেকে ৩ মাইল দূরে চন্দ্রপুর-লাতুমুড়া যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আব্দুল কাদেরসহ মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল চন্দ্রপুর-লাতুমুড়ায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। সারারাতের যুদ্ধে কয়েকজন হানাদার সৈন্য হত্যাহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
এদিকে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরও ঢাকার মিরপুর এলাকা তখনাে শত্রুমুক্ত হয়নি। প্রায় দেড় মাস এ এলাকা স্বাধীনতাবিরােধী অবাঙালি সশস্ত্র বিহারিদের দখলে ছিল। কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্যও পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৬ই ডিসেম্বর থেকে মিত্রবাহিনী সমগ্র এলাকা ঘেরাও করে রাখে। বাংলাদেশ সরকার বারবার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও বিহারিরা আত্মসমর্পণ করেনি। এ অবস্থায় সরকার এখানে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭২ সালের ২৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখানে অভিযান পরিচালনা শুরু করে। এদিন ক্যাপ্টেন হেলাল মাের্শেদ, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এক কোম্পানি সেনাসদস্য মিরপুর যান এবং ১নং সেকশনের মাজারের পার্শ্ববর্তী স্কুল ও ২নং সেকশনের বায়তুল আমান হাউস নামে একটি বাড়িতে অবস্থান নেন। সন্ধ্যায় হাবিলদার ওয়াজেদ আলী বারকি, বীর প্রতীক-এর নেতৃত্বে এক প্লাটুন সেনা ১১নং সেকশনের পুলিশ পােস্টের কাছে মােতায়ন করা হয়। এদিন রাতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ এলাকা ছেড়ে যান। ৩০শে জানুয়ারি সকালে পুলিশ এসে সেনাসদস্যদের সঙ্গে যােগ দেয় এবং বিভিন্ন পয়েন্টে তাদের মােতায়েন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, পুলিশ বাড়িঘরে তল্লাশি করে চিহ্নিত লােকজনকে গ্রেপ্তার করবে এবং সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করবে।
বেলা ১১টার দিকে চতুর্দিকের বাড়িঘর থেকে বিহারিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে একযােগে হেলাল মাের্শেদের নেতৃত্বাধীন সেনা ও পুলিশের ওপর একযােগে আক্রমণ চালায়। এরূপ আক্রমণের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মােটেই প্রস্তুত ছিল না। এ অভিযানে সেনাবাহিনীর ৪র্থ ও ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল মুক্তিযােদ্ধা অংশ নেন। ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দলে ছিলেন আব্দুল কাদের। তিনিসহ বেশ কয়েকজন সেনা ও পুলিশ সদস্য এখানকার অভিযানে শহীদ হন। পরবর্তীতে সহযােদ্ধারা শহীদ আব্দুল কাদেরের মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা সেনানিবাস কবরস্থানে সমাহিত করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান এবং দেশকে হানাদারমুক্ত করতে গিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে শাহাদত বরণ করায় বাংলাদেশ সরকার আব্দুল কাদের-কে ‘বীর প্রতীক’ (মরণােত্তর) খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড