বীর প্রতীক আব্দুল আউয়াল সরকার
আব্দুল আউয়াল সরকার, বীর প্রতীক (১৯৩৪-১৯৯৩) আত্মঘাতী কমান্ডাে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ-সেনা ও অপারেশন হটপ্যান্টসে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৩৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার মাদগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আফতাব উদ্দিন সরকার এবং মাতার নাম কেলেস্তারা বিবি। আব্দুল আউয়াল সরকারের পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যােগদানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীতে চাকরি শুরু। ১৯৭১ সালে তিনি নৌজাহাজ পিএনএস বাবর-এ কর্মরত ছিলেন। করাচি বন্দরে অবস্থানকালে তিনি ফেব্রুয়ারিতে ৩ মাসের ছুটি নিয়ে নিজ বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালিদের ওপর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর আব্দুল আউয়াল সরকার মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি প্রথমে ২ নম্বর সেক্টরে মেজর খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তম-এর অধীনে যুদ্ধ শুরু করেন। শুরুর দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেকি করতে এসে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং কৌশলে মুক্ত হয়ে ভারতে চলে যান। পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌদলে অন্তর্ভুক্ত হন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনকালে তাঁকে এ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তিনি পলাশি গিয়ে আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য ভারত সরকারের দেয়া টাগবােটে বেফোর্স গান লাগিয়ে যুদ্ধ জাহাজে রূপান্তর করে নাম দেয়া হয় ‘বিএনএস পদ্মা’ ও ‘বিএনএস পলাশ’। আব্দুল আউয়াল সরকাররকে পলাশে ন্যস্ত করা হয়। পাকিস্তানি নৌঘাটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে ৭ই ডিসেম্বর এ-যুদ্ধ জাহাজ দুটি মিত্রবাহিনীকে অবহিত না করে খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। এ অপারেশনের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন হটপ্যান্টস’। হলদিয়া ঘাট থেকে তাঁরা অভিযান শুরু করেন। পথে মিত্রবাহিনীর দুটি রণতরী আইএনএস প্যানভেল এবং চিত্রাঙ্গদা তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়। ৯ই ডিসেম্বর মধ্যরাতে রণতরীগুলাে বাংলাদেশের আকরাম পয়েন্টে এবং ১০ই ডিসেম্বর মংলায় পৌঁছায়। চূড়ান্ত অভিযানের জন্য রণতরীগুলাে খুলনার পাকিস্তানি নৌ-ঘাটির কাছাকাছি আসতেই আকাশে ৩টি জঙ্গী বিমান দেখা যায়। শত্রুবিমান মনে করে পদ্মা ও পলাশ যুদ্ধ জাহাজ থেকে নৌযােদ্ধারা বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে উদ্যত হন। এমন সময় আইএনএস প্যানভেল থেকে ওয়ারলেসে জানান হয় এগুলাে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান। প্রথমে যুদ্ধ বিমানগুলাে কিছুটা নিচু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরের দিকে চলে যায়। ১০-১২ মিনিট পর হঠাৎ ঘুরে এসে বিএনএস পদ্মার ওপর বােমাবর্ষণ করে। যদিও গানবােটগুলাে শনাক্তের জন্য ১৫x১০ ইঞ্চি চওড়া হলুদ কাপড় ছাদে বিছানাে ছিল। তারপরও এ দুর্ঘটনা ঘটে। বােমার আঘাতে মুক্তিবাহিনীর গানবােটে আগুন ধরে যায় এবং ইঞ্জিন রুমে পানি ঢুকতে থাকে। দুটি গানবােটে আ. আউয়াল সরকারসহ ৫৬ জন নৌযােদ্ধা ছিলেন। বিপদ দেখে কেউ-কেউ নদীতে ঝাঁপ দেন। অনেকেই গােলার আঘাতে শহীদ হন। আ. আউয়াল সরকার আহত ২-৩ জনকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। সাঁতরে নদীর কিনারে এলে আ. আউয়াল সরকার, রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ-সহ কয়েকজনকে রাজাকাররা আটক করে। রুহুল আমিনকে রাজাকাররা সঙ্গে-সঙ্গে নির্যাতন শেষে হত্যা করে। আ. আউয়াল সরাকারসহ বাকিদের নির্যাতন শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করে এবং কারাগারে পাঠায়। স্বাধীনতার পর আ. আউয়াল সরকার মুক্তি পান। অপারেশন হটপ্যান্টস-সহ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার আ. আউয়াল সরকারকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে।
স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হন এবং লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রী হালিমা খাতুন সিদ্দিক। ৬ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানের জনক আ. আউয়াল সরকার ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। (মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড