বীর উত্তম আবুল মঞ্জুর
আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তম (১৯৪০-১৯৮১) বীর মুক্তিযােদ্ধা ও ৮নং সেক্টরের কমান্ডার। ১৯৪০ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার গােপীনাথপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পৈতৃক নিবাস নােয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলাধীন কামালপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মাে. নজিবুল্লাহ ও মাতার নাম সামছুন নাহার। এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের মধ্যে মঞ্জুর ছিলেন তৃতীয়। মঞ্জুরের পিতা অবিভক্ত বাংলার আইন সভার রেজিস্ট্রার ছিলেন। পিতার চাকরির সুবাদে তিনি কিছুকাল কলকাতায় লেখাপড়া করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি পাকিস্তানের সারগােদা রয়েল এয়ার ফোর্স স্কুলে ভর্তির সুযােগ পান। সেখান থেকে ১৯৫৫ সালে সিনিয়র কেমব্রিজ এবং ১৯৫৭ সালে লাহাের থেকে আইএসসি পাস করেন। এরপর তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে জেন্টলমেন ক্যাডেট হিসেবে যােগ দেন। ১৯৬০ সালে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬১ সালে তিনি ব্রিটেনের স্যান্ডহাস্টে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য মনােনীত হন, কিন্তু পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় সেখানে যােগ দিতে পারেননি। ১৯৬৪ সালে তিনি সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবারও কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র না পাওয়ায় তিনি সিএসপি পদে যােগদান করতে অসমর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি কানাডার ডিফেন্স সার্ভিসেস্ স্টাফ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পিএসসি কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীতে তাঁর র্যাংক ছিল মেজর।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে মেজর এম এ মঞ্জুর পাকিস্তানের শিয়ালকোটে একটি ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পাকিস্তানিদের কর্তৃক কীভাবে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা ও তাদের হেয় চোখে দেখা হয়, সেনাবাহিনীর চাকরিকালে তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তা মর্মেমর্মে উপলব্ধি করেন। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে ওঠে। তিনি এ ব্যাপারে সুযােগ খুঁজছিলেন। ২৫শে জুলাই তিনি তাঁর স্ত্রী, শিশু সন্তান এবং মেজর আবু তাহের, মেজর জিয়াউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীসহ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গােপনে স্থলপথে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সীমান্ত অতিক্রম করে দিল্লি হয়ে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা কলকাতায় পৌছান। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক মেজর মঞ্জুরকে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর স্থলে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার নিয়ােগ করা হয়। তিনি ১৮ই আগস্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা ও ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে ৮নং সেক্টর গঠিত হয়। এর হেডকোয়ার্টার্স ছিল যশােরের বেনাপােলে। এ সেক্টরকে ৭টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়, যথা- বয়ড়া, হাকিমপুর, ভােমরা, লালবাজার, ব্যানপুর, বেনাপােল ও শিকারপুর। নিয়মিত ও অনিয়মিত বা গণবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়।
দায়িত্ব গ্রহণের পর মেজর মঞ্জুর দেখেন যে, নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পকেট থেকে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করছেন। মূল ভূখণ্ডে শত্রুঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালনা ও তাদের বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি প্রথমদিকে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করেন। এজন্য অনিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের সময় কমিয়ে আনেন। এভাবে প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিমাসে প্রায় ৩ হাজার গণবাহিনীর সদস্যদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাের ব্যবস্থা করেন। এরপর তিনি ক্রমান্বয়ে থানা দখলের দিকে নজর দেন। তাঁর অধিনায়কত্বকালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর খুলনার শিরােমণিতে। স্থানটি ছিল খুলনা শহর থেকে ১৪ কিমি উত্তরে খুলনা-যশাের রােডে। সেদিক থেকে এটি ছিল খুলনার প্রবেশদ্বার। ১৩ই ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী- খুলনা শহর দখলের যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব থেকেই এখানে ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খানের নেতৃত্বে একটি ট্যাংক রেজিমেন্টসহ দুর্ভেদ্য ঘাঁটি নির্মাণ করে অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনী কিছুতেই শত্রুবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে অগ্রসর হতে পারছিল না। তাঁদের বহু সৈন্য হতাহত হন। এ পর্যায়ে মেজর মঞ্জুরের ওপর যুদ্ধের অধিনায়কত্ব ন্যস্ত করা হয়। তিনি নতুন যুদ্ধকৌশল নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়েন। মূল যুদ্ধ হয় ১৬ই ডিসেম্বর। এদিন ঢাকায় জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও খুলনায় এর কোনাে লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় মেজর মঞ্জুর তাঁর সুইসাইড স্কোয়াডের কমান্ডােদের নিয়ে মিত্রবাহিনীর ট্যাংকের আড়ালে ঝটিকা গতিতে শত্রুর ট্যাংক বহরের ব্যুহ ভেদ করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে থাকেন। শত্রুর ট্যাংক আর বাংকারগুলাে নিমেষে গুড়াে-গুড়াে হয়ে যায়। ১৭ই ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মেজর মঞ্জুরের অপরিসীম সাহস ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল শিরােমণির যুদ্ধ বিজয়ের মূলে। সামরিক বিদ্যায় এটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, শিরােমণি যুদ্ধ ভারতের দেরাদুন এবং ব্রিটিশ স্যান্ডহাস্ট আর্মি একাডেমিতে এ বিষয়ে পাঠদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা-উত্তরকালে মেজর এম এ মঞ্জুরকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে মেজর মঞ্জুর লে. কর্নেল এবং একই বছর কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তাঁকে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি দিয়ে যশাের ৫৫ ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। একই বছর তাঁকে চিফ অব জেনারেল স্টাফ পদে নিয়ােগ দেয়া হয়। ১৯৭৭ সালে তাঁকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি করা হয়। ১৯৮১ সালের ২৯শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বীর উত্তমকর্তৃক তাঁকে মিরপুর ডিফেন্স সার্ভিসেস্ কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট হিসেবে বদলির নির্দেশ দেয়া হয়। এর একদিন পর ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একটি প্রােগ্রাম উপলক্ষে রাত্রি যাপনকালে কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী সেনাসদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এ ঘটনার পর আত্মগােপনের চেষ্টাকালে ২রা জুন জেনারেল মঞ্জুর জেনারেল জিয়ার অনুগত সেনাসদস্যদের হাতে ধরা পড়েন এবং সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে হত্যা করা হয়।
মেজর জেনারেল মঞ্জুর একজন অত্যন্ত মেধাবী, সাহসী ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের অবসান ঘটে বটে, তবে দেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদান চিরস্মরণী হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (কম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র দশম খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয় ১৯৮৪, পৃ. ৩৬৯-৩৭১; মাে. নূরুল আনােয়ার, মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড : দুর্যোধনটি কে? ঢাকা, ঐতিহ্য ২০১৭।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড