You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর বিক্রম আবুল কালাম আজাদ

আবুল কালাম আজাদ, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৫২) কলেজ ছাত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারী বীর মুক্তিযােদ্ধা এবং পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে নির্মম নির্যাতন ও কারাবাস ভােগকারী। তিনি ১৯৫২ সালের ৩রা এপ্রিল টাঙ্গাইল সদর থানার পার দিঘলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম কাসেমউদ্দিন সরকার ও মায়ের নাম সালেহা বেগম। ২ ভাই ও বােনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ১৯৭১ সালে তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন।
৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযােগ আন্দোলন-এর ডাক দিলে টাঙ্গাইলের ছাত্র-যুবকরা এতে একাত্মতা ঘােষণা করেন। ৩রা। মার্চ টাঙ্গাইলের কাগমারি মৌলানা মােহাম্মদ আলী কলেজের মাঠে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ১৭ জন স্থানীয় ছাত্র-যুবক নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এ ১৭ জনের একজন ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। তাদের বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ২৫শে মার্চের পর তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় আরাে ৩ শতাধিক ছাত্র-যুবক ও আনসার এ প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
টাঙ্গাইল জেলার বাশাইল থানার নাটিয়াপাড়া নামক স্থানে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এপ্রিলে পরিচালিত প্রতিরােধযুদ্ধে আবুল কালাম আজাদ অংশ নেন। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি ও অন্য মুক্তিযােদ্ধারা টাঙ্গাইলের পুরাতন আদালত প্রাঙ্গণের ট্রেজারি ভেঙ্গে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কাদের সিদ্দিকীর ট্রাকে তুলে দেন। কাদের সিদ্দিকী অস্ত্রবাহী ট্রাক নিয়ে সখিপুর পাহাড়ের দিকে চলে গেলে তারাও নিরাপদ স্থানে সরে পড়েন। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বহেরাতলীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করে মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আবুল কালাম আজাদ এ ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। এডভােকেট সােহরাওয়ার্দী, সােহরাব আলী খান আরজু, আবু মােহাম্মদ এনায়েত করিম, খােন্দকার আশারফউজ্জামান স্মৃতি ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের একত্রিত করে কালিহাতী থানার যােগারচর গ্রামের মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হন। এ মুক্তিযােদ্ধারা পরে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যুক্ত হন। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে এনায়েত করিমকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আব্দুল গফুরকে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আবুল কালাম আজাদকে গ্রুপ কমান্ডার, নজরুল ইসলাম বাকুকে সহকারী কমান্ডার এবং মােয়াজ্জেম হােসেন খান ও বুলবুল খান মাহবুবকে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তাদের টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন স্থানে রাজাকার, আলবদর ও পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণের দায়িত্বও প্রদান করা হয়।
টাঙ্গাইল প্রধান সড়কে রাজাকার কমান্ডার খােকা রাজাকারের বাড়িতে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ এখানে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এক ভােররাতে আবুল কালাম আজাদ সহকারী কমান্ডার নজরুল ইসলাম বাকুকে নিয়ে খােকা রাজাকারের বাড়িতে আক্রমণ চালান। বাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তারা সরে পড়েন। টাঙ্গাইল প্রধান সড়কে ঢাকাইয়া পট্টির বারান্দায় ১৬-১৭ জন রাজাকার রাত্রিযাপন করত। জুনের শেষদিকে আবুল কালাম আজাদ নজরুল ইসলাম বাকুকে নিয়ে ভােররাতে এ রাজাকারদের লক্ষ করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে ৪-৫ জন রাজাকার আহত হয়। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পুকুরের পূর্বপাশে পােস্ট অফিস এবং টেলিগ্রাম অফিসের মাঝামাঝি স্থানে মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক বিকেলে আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা শাহজাহান মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্পে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। টাঙ্গাইল থানার চারপাশে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ সদস্যরা বালির বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি করেছিল। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আবুল কালাম আজাদ টাঙ্গাইল থানা অপারেশনের জন্য থানা। সংলগ্ন বিআইডিসি ডিপাে জমিদার বাড়ির সামনের লিচু গাছে চড়ে সারারাত অপেক্ষা করেন। ফজরের আজানের সময় লিচু গাছ থেকে নেমে থানায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন।
কাদেরিয়া বাহিনীর এনায়েত করিম, মােয়াজ্জেম হােসেন খান, কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল গফুর ও বুলবুল খান মাহবুব আবুল কালাম আজাদকে টাঙ্গাইল শহরে বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার ধ্বংস করার দায়িত্ব দেন। আবুল কালাম আজাদ ও নজরুল ইসলাম বাকু করটিয়ার ভাতকুড়া ট্রান্সমিটার ধ্বংস করতে ১৬ই আগস্ট বিকেলে সেখানে যান। ভাতকুড়া গােরস্থানে ঢুকে একটি কবরে আবুল কালাম আজাদ ও নজরুল ইসলাম বাকু এক্সপ্লোসিভ ও গ্রেনেড লুকিয়ে রাখেন। তাঁরা দুজন সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটক্ষেতে লুকিয়ে থাকেন। রাত ৮টার দিকে ট্রান্সমিটারের কাছে গিয়ে তারা এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করার জন্য মাটি খোড়েন। এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামে। চারদিক গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যায়। অপারেশন না করে তাঁরা ফিরে আসেন। সেখান থেকে তাঁরা পাকরাইলের দিকে রওনা হন। এমন সময় লক্ষ করেন দু-তিনজন রাজাকার তাদের দিকে ছুটে আসছে। ভাতকুড়া রাস্তা পার হয়ে দক্ষিণের দিকে এগিয়ে গেলে রাজাকাররা তাদের রাস্তা রােধ করে। তারা পেছন ফিরে তাকাতেই দেখেন পাকবাহিনী, পুলিশ ও রাজাকাররা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। নজরুল ইসলাম বাকু বিপদ বুঝে দৌড়ে পালানাের চেষ্টা করেন। আবুল কালাম আজাদ শক্রর হাতে প্রাণ না দিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। তখনাে বৃষ্টি পড়ছিল। এর মধ্যে দ্রুত তিনি একটি জমির উঁচু আইল সামনে রেখে পজিশন নেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা বৃষ্টির মতাে গুলি করতে-করতে তাঁর দিকে এগুতে থাকে। তিনি তাদের প্রতিরােধ করার জন্য কিছুক্ষণ পরপর একটি করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকেন। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছােড়া একটি গুলি আবুল কালাম আজাদের বাম পায়ে বিদ্ধ হয়। বাম চোখ ঘেঁষে অন্য একটি গুলি বেরিয়ে যায়। চোখের নিচের হাড় ভেঙ্গে যায়। তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। জ্ঞান ফিরে তিনি দেখেন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তাকে ক্রমাগত আঘাত করছে। দুহাত পিছমােড়া করে গামছা দিয়ে বাঁধা। তাঁর শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। এ অবস্থায় তাঁকে খালপাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে নজরুল ইসলাম বাকু গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়েছিলেন। তখনাে তিনি বেঁচে আছেন। ইকবাল নামে এক রাজাকার নজরুল ইসলামের ওপর ৯টি গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। এরপর রাজাকার ইকবাল আবুল কালাম আজাদকে হত্যা করার জন্য বুকে রাইফেল তাক করে। রাজাকার বটু পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলে একে হত্যা না করে এর কাছ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে গােপন তথ্য বের করা যাবে। তার কথা শুনে ক্যাপ্টেন আবুল কালাম আজাদকে হত্যা না করার নির্দেশ দেয়। সেখান থেকে তাঁকে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে নেয়া হয়। তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানাে হয়। এরপর দুদিন তাঁর বিবৃতি নেয়া হয়। ২১শে আগস্ট গুলি করে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে তাঁকে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজের পাশে পানির ট্যাংকের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন সময় তাঁকে সার্কিট হাউজে নেয়ার জন্য ওয়ারলেস ম্যাসেজ আসে। পাকসেনারা তাঁকে সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। সেখানে ভয়েজ অব আমেরিকা, বিবিসি ও সিএনএন-এর কয়েকজন সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার ভিডিও করেন। পরে তাঁর সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করা হয়। এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পাকবাহিনী প্রমাণ করতে চায় যে, তিনি ভারতের অনুচর। এদিনই পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে সেখান থেকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। সকাল, দুপুর ও বিকেলে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানাে হয়। অতঃপর তাঁকে এফআইইউ ডিভিশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কেউ জীবিত ফিরে আসেনি। পাকসেনারা তাঁর কাছ থেকে গােপন তথ্য বের করতে ব্যর্থ হয়ে লােহার রড আগুনে লাল করে তার চোখ উপড়ে ফেলার জন্য এগিয়ে আসে। সেখানে অবস্থানরত একজন মেজর এ কাজ করা থেকে তাদের বিরত করে। তারা তার চোখ উপড়ে না ফেলে কপিকল দিয়ে তাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দুই পায়ের তলায় গরম লােহার রড ঢুকিয়ে দেয়। তিনি জ্ঞান হারান। কিছুদিন পর তার জ্ঞান ফেরে। তিনি দেখেন তার ক্ষতস্থানে পােকা ধরেছে। এখান থেকে তাঁকে রেডিও পূর্ব পাকিস্তান ঢাকা সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে তাঁর বিবৃতি রেকর্ড করা হয়। সেখান থেকে তাঁকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে প্রেরণ করা হয়। স্পেশাল মার্শাল ল ট্রাইবুন্যাল কোর্টে তাঁর বিচার হয়। ২রা ডিসেম্বর স্পেশাল মার্শাল ল ট্রাইবুন্যাল কোর্ট তাঁকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১৫টি বেত্রাঘাতের আদেশ দেয়। ৩রা ডিসেম্বর তাঁকে দেয়া বেত্রাঘাতের নির্দেশ কার্যকর করা হয়। এতসব সত্ত্বেও তাঁর কাছ থেকে কোনাে তথ্য তারা বের করতে পারেনি। স্বাধীন দেশে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসহ্য নির্যাতন ভােগ ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করার স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর সরকার আবুল কালাম আজাদকে ‘বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ২ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম জেসমিন আক্তার। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!