You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী

আবু সাঈদ চৌধুরী (১৯২১-১৯৮৭) সাবেক বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার-এর বিশেষ প্রতিনিধি এবং স্বাধীনতাপরবর্তী রাষ্ট্রপতি টাঙ্গাইল জেলার এক বনেদি পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল হামিদ চৌধুরী এবং মাতা শামসুন্নেসা চৌধুরী। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি স্নাতক সম্মান (১৯৪০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স (১৯৪১) ও এলএলবি এবং লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে বার-এট-ল ডিগ্রি (১৯৪৭) অর্জন করেন। এরপর ঢাকায় আইন পেশায় যােগ দেন। পরে হাইকোর্টের বিচারপতি (১৯৬১) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে (১৯৬৯-১৯৭১) অধিষ্ঠিত ছিলেন।
ছাত্রজীবন থেকেই আবু সাঈদ চৌধুরী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। সত্যবাদী হিসেবে সর্বমহলে তার পরিচিতি ছিল। এজন্য হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীও তাকে গুরুত্ব দিতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে বিচারপতি চৌধুরী (তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে এর অধিবেশনে যােগ দিতে জেনেভায় যান। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে মার্চ মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন ছাত্র গুলিতে নিহত হলে তিনি প্রতিবাদে জেনেভায় থাকা অবস্থায় ১৫ই মার্চ উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে লেখা পদত্যাগ পত্রে তিনি বলেন, ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসহ ঢাকা শহর ও দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের এ নির্বিচার গণহত্যার খবর তাঁকে খুবই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করে। হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককেও ঐ রাতে হত্যা করে। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি জেনেভা থেকে লন্ডন চলে আসেন। এর পরপর ২৭শে মার্চ তিনি ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণএশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করে ঘােষণা করেন এই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক রইল না। আমি দেশ থেকে দেশান্তরে যাব আর পাকিস্তানী সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতানির্মমতার কথা বিশ্ববাসীকে জানাব। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর লন্ডনভিত্তিক বহির্বিশ্বে নেতৃত্বদান ও গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা পালনের এক সােনালি অধ্যায়। এদিকে ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত এবং ১৭ই এপ্রিল ঐ সরকারের শপথ গ্রহণের পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ দান করা হয়। ২৩শে এপ্রিল তিনি তার নিয়ােগপত্র লাভ করেন। তিনি ব্রিটেন ও ইউরােপের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উপচার্য এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি এসােসিয়েশন, বিশ্ব শান্তি পরিষদ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সােসালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকতা ও বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানদের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেন। তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ও পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাসহ বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন। লন্ডনসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর, ইউরােপের বিভিন্ন দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্টে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত বিভিন্ন একশন কমিটির মধ্যে সমন্বয় সাধন, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠান, বিবিসি ও অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেল এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দান, প্রচারপত্র তৈরি ও বিতরণ, পােস্টার-প্ল্যাকার্ড হাতে হাউজ অব কমন্স ও জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থার সদর দপ্তরে প্রবাসী বাঙালিদের কর্তৃক মানববন্ধনের আয়ােজন, ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে বৈঠক ও লবিং, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর দুরবস্থা, পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি ও অন্যান্য সাহায্য বন্ধ, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর বিচারের কার্যক্রম বন্ধ করে তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দানের বিষয়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে যােগাযােগ ও তাদের সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করেন। লন্ডনের ১১ গােরিং স্ট্রিটে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ হাউজ’ ছিল তার এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার হেডকোয়ার্টার্স। ২৭শে আগস্ট লন্ডনের ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনস-এ তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দূতাবাসের অফিস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে তিনি এর উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ভূমিকা চিরস্মরণীয়। তাঁর রচিত প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি (ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০) বই থেকে মুক্তিযুদ্ধকালে বহির্বিশ্বে তার এসব ভূমিকা সম্বন্ধে সবিস্তার জানা যায়।
স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন, যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৩ সালের ২৪শে ডিসেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন তাঁর সরকারের মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তাঁর জীবনের একমাত্র কলঙ্কজনক ঘটনা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মােশতাকের সরকারে মন্ত্রী হিসেবে তাঁর যােগদান, যদিও পরবর্তীতে তিনি এ ব্যাপারে গভীর অনুশােচনা করেন। তিনি ১৯৮৭ সালের ২রা আগস্ট লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!