বীর উত্তম আবু তাহের
আবু তাহের, বীর উত্তম (১৯৩৮-১৯৭৬) বীর মুক্তিযােদ্ধা, ১১নং সেক্টর কমান্ডার ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সংঘটিত সেনাঅভ্যুত্থানের তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৩৮ সালের ১৪ই নভেম্বর আসামের বদরপুরে আবু তাহেরের জন্ম। নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে তাদের নিবাস। তার পিতার নাম মহিউদ্দীন আহমেদ এবং মাতার নাম আশরাফুন্নেসা। পিতা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। পূর্বধলার শ্যামগঞ্জে তাহেরের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। পিতার কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে তাঁকে বিভিন্ন স্থানে পড়াশুনা করতে হয়। তিনি চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। সে-সময় তিনি বিপ্লবী রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। তিনি ১৯৫৫ সালে কুমিল্লার ইউসুফ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৭ সালে সিলেট এম সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতকোত্তর ১ম পর্বে ভর্তি হন, কিন্তু তা শেষ না করে একই বছর (১৯৬০) পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ১৯৬১ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিসেস (কমান্ডাে বাহিনী)-এ যােগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি আমেরিকায় গেরিলা যুদ্ধের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং সেখান থেকে সমরবিদ্যায় গ্রাজুয়েশন প্রাপ্ত হন। ১৯৭১ সালে আবু তাহের সেনাবাহিনীর চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ােজিত ছিলেন। তখন তার র্যাঙ্ক ছিল মেজর।
১৯৬৯ সালে আবু তাহের বর্তমান কিশােরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের ডা. শেখ খুরশিদউদ্দিন আহমেদের কন্যা লুৎফা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তান রয়েছে। আবু তাহের ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা ও দেশপ্রেমিক একজন সৈনিক। সৈনিকের পেশায় নিয়ােজিত থেকেও তিনি ছিলেন সমাজ ও রাজনীতি সম্বন্ধে খুবই সচেতন। বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা প্রতিবাদমুখর ছিলেন। ৭০-এর নির্বাচন ও নির্বাচনােত্তর ঘটনাবলির ওপর পাকিস্তানে থাকা অবস্থায় তিনি তীক্ষ দৃষ্টি রাখছিলেন। নির্বাচনের রায় মেনে নিয়ে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ-র হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না বলে তিনি মনে করতেন। তিনি এও মনে করতেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য। তাই তিনি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে দেশে পাঠিয়ে দেন। ৭১-এর ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ এবং নির্বিচার গণহত্যার সমালােচনা করায় তাকে কোয়েটা স্টাফ কলেজে বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স থেকে প্রত্যাহার করে নজরদারিতে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের জন্য তিনি সুযােগ খুঁজছিলেন। ২৫শে জুলাই গােপনে মেজর তাহের, মেজর এম এ মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের এবােটাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করেন। অনেক বাধা-বিপত্তি ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করে তাঁরা ২৭শে জুলাই দিল্লি এবং আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় পৌঁছান। মুজিবনগর সরকার তাঁকে ১১নং সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে এ সেক্টর গঠিত ছিল। ভারতীয় সীমান্ত এলাকার মানকারচর থেকে মহেশখােলা পর্যন্ত ছিল এর বিস্তৃতি। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জে ছিল এর হেডকোয়ার্টার্স। কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর মেজর আবু তাহের এ সেক্টরটিকে সুসংগঠিত ও সুবিন্যস্ত করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমগ্র এলাকাকে তিনি ৮টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন, যথামানকারচর, মহেন্দ্রগঞ্জ, পুরাকাশিয়া, ডালু, বাগমারা, শিববাড়ি, রংড়া ও মহেশখােলা। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ সেক্টরে ৩ হাজার নিয়মিত এবং ১৭ হাজারের মতাে গণবাহিনীর সদস্য ছিল। সুশৃঙ্খল নিয়মিত বাহিনী গড়ে না ওঠা পর্যন্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের ওপর গুরুত্বারােপ করেন। কুড়িগ্রামের রৌমারি মুক্ত অঞ্চলে তাঁর একটি ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল। এছাড়া তাঁর হেডকোয়ার্টার্সে অপর একটি ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে তিনি শুধু গরিব কৃষকদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেন। ছাত্র, যুবক ও কৃষকদের গেরিলা ট্রেনিং-এর পাশাপাশি তিনি তাদের রাজনীতি-সচেতন করে গড়ে তুলতেও সচেষ্ট হন। তিনি তাঁর সেক্টরে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করেন।
১১নং সেক্টরের বাইরেও ৭নং সেক্টরের অধীন রংপুর ও বগুড়ার অনেক স্থানে তিনি ও তাঁর বাহিনী যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এর মধ্যে চিলমারীর যুদ্ধ, কামালপুরের যুদ্ধ, টেলিখালির যুদ্ধ, বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধ, হালুয়াঘাটের যুদ্ধ, বক্সীগঞ্জের যুদ্ধ ও কোদালকাঠির যুদ্ধ উল্লেখযােগ্য। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে নেত্রকোনা ও কিশােরগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল কর্নেল তাহেরের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। তার মূল টার্গেট ছিল জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে যতদ্রুত সম্ভব ঢাকায় পৌছানাে। সেক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী জামালপুরের কামালপুর শত্রুঘাঁটি দখলে নেয়া ছিল খুবই জরুরি। সেদিক বিবেচনায় রেখে মেজর আবু তাহেরের বাহিনী বহুবার ঐ ঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালনা করে। পাকহানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্র, চতুর্দিকে বাঙ্কার ও প্রচুর সৈন্য মােতায়েনের মাধ্যমে কামালপুরে একটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটি নির্মাণ করে। ভারতীয় সৈন্য ও আর্টিলারির সাহায্য নিয়ে মেজর তাহেরর নেতৃত্বে ১৪ই নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধাদের একটি শক্তিশালী দল কামালপুর শত্রুঘাঁটির ওপর তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। গভীর রাতে শুরু হয়ে সকাল পর্যন্ত ঐ যুদ্ধ চলে। তাদের এ আক্রমণে একজন মেজরসহ প্রায় দুই কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়। হঠাৎ শত্রুর একটি মর্টারের গােলা মেজর তাহেরের বাঁ পায়ের ওপর এসে পড়লে হাঁটুর ওপর থেকে পা-টি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাঁকে সঙ্গে-সঙ্গে ভারতের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময়ে এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মেজর আবু তাহেরকে স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশ সরকার বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে।
ভারতে চিকিৎসা শেষে এপ্রিল মাসে (১৯৭২) দেশে প্রত্যাবর্তনের পর আবু তাহেরকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেল পদে নিয়ােগ দেয়া হয়। একই বছর তাঁকে কর্নেল র্যাঙ্কে উন্নীত করা হয়। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর ৪৪তম ব্রিগেড ও কুমিল্লা সেনানিবাসের অধিনায়কের দায়িত্ব লাভ করেন। সেনাবাহিনী গঠন সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয়ায় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং জাসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জাসদের সমর্থনে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে একটি গােপন সংগঠন গড়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের সিপাহি অভ্যুত্থানের তিনি ছিলেন প্রধান সংগঠক। জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-কে পক্ষে নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা ছিল ঐ অভ্যুত্থানের পেছনে জাসদের লক্ষ্য। একই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরােহণে জিয়াউর রহমানও সাময়িক সময়ের জন্য হলেও কর্নেল তাহের ও জাসদ-কে তাঁর পক্ষে ব্যবহার করেন। জেনারেল জিয়া শীঘ্রই কর্নেল তাহের ও জাসদ-কে তার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা ও তা সুসংহত করার ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলে কর্নেল তাহের ও জাসদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে ২৪শে নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়। এরপর এক সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দিয়ে ঐ মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে পা হারানাের পর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে জীবন দিতে হয়। এভাবে তাঁর জীবনের অবসান ঘটলেও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: কর্নেল আবু তাহেরের সাক্ষাত্তার (১০-৬-১৯৭৫), হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড, তথ্যমন্ত্রণালয় ১৯৮৪, পৃ. ৪৪৮-৪৫৯; লুফা তাহের (স্ত্রী)-এর সাক্ষাৎকার (১০-১১-২০১৮); ওয়ারেসাত হােসেন বেলাল এমপি (কনিষ্ঠ ভ্রাতা)-র সাক্ষাৎকার (৯-১১-২০১৮)
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড