You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক আবু তাহের মাে. সালাহউদ্দিন - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক আবু তাহের মাে. সালাহউদ্দিন

আবু তাহের মাে. সালাহউদ্দিন, বীর প্রতীক (১৯৪৫) বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৪৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডু উপজেলার মসজিদ্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জহুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং মাতার নাম আনােয়ারা বেগম। তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রামের সেন্ট প্রাসিডস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবছরই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যােগদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এবােটাবাদের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ১৯৬৫ সালের ৩১শে অক্টোবর তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন এবং যশাের সেনানিবাসের ৭ম ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যােগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সালাহউদ্দিন ঢাকা সেনানিবাসে ৬০৪ ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট এর নামে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্মম গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে সালাহউদ্দিন এর প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। কয়েকদিন পর তিনি ও মােহাম্মদ মােস্তাফিজুর রহমান, বীর বিক্রম- ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে পায়ে হেঁটে যশােরকুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রতিরােধ যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যােগ দেন। উল্লেখ্য, মুজিবনগর সরকার (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার)-এর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে (মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা) যে চৌকস দলটি গার্ড অব অনার প্রদান করে, সালাহউদ্দিন ছিলেন তার সেকেন্ডইন-কমান্ড। কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদর দফতরে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর পিএস এবং গােয়েন্দা বিভাগের প্রথম ডাইরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের (৮নং থিয়েটার রােডে অবস্থিত) লিয়াজো অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সেক্টরভিক্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রথমে ৮নং সেক্টরের অধীন সাতক্ষীরার ভােমরা সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ৫নং সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
আবু তাহের সালাহউদ্দিন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যেসকল সফল যুদ্ধ পরিচালনা করেন, সে-সবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য সাতক্ষীরা জেলার ভােমরা বাধ যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মে মাসে সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাগণ এ বাঁধে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ২৯শে মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের দুটি কোম্পানি আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ক্যাম্পে আকস্মিকভাবে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা অত্যন্ত সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। এক পর্যায়ে শত্রুসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর পাকিস্তানি সেনারা শক্তি বৃদ্ধি করে পুনরায় সংগঠিত হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। সালাহউদ্দিন এবারও সহযােদ্ধাদের নিয়ে শত্রুসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করেন। প্রায় সাড়ে পনের ঘণ্টা ব্যাপী এযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে গেরিলা কায়দায় সুইপিং ফায়ার করেন। এতে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৬৩৮ জন শত্রুসৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের সাতটি মৃতদেহ মুক্তিযােদ্ধারা কলকাতার গড়ের মাঠে প্রদর্শন করেন। এযুদ্ধে দুজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের জানাজায় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন। জানাজা শেষে শহীদদের ভােমরা বর্ডারের ওপারে ভারতীয় ভূখণ্ডে দাফন করা হয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার আবু তাহের মাে. সালাহউদ্দিনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৫২, খেতাবের সনদ নং ২)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন এবং ১৯৭৮ সালে কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৮ সালের ১০ই মার্চ তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি তিন কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম দিলরুবা সালাহউদ্দিন। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড