পঞ্চাশ দশকে আমরা | গাজীউল হক | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪
সুলতান সেদিন মারা গেছে। মোহাম্মদ সুলতান। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।
তখনও পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়নি। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের করিডোরে একটি লোহার খাটে শাদা চাদর দিয়ে ঢাকা তার প্রাণহীন দেহ। মাথার কাছে একটা চুলের ওপর বসে আছি। শিথানে দাঁড়ানো হাজারী, হেনরী এবং আরও দুটি ছেলে। স্তব্ধ হয়ে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কামরুননাহার লাইলী এবং আমার স্ত্রী। লাইলী বললেন, মৃদু স্বরে ‘আমাদের পরিণতি।’
উত্তরে কিছু বলতে পারিনি। চীৎকার করে বা ডুকরে কাঁদবার শক্তি ছিল না। গলাটা যেন কে চেপে ধরেছিল। অসহ্য ক্রোধে কাঁপছিলাম। অসহায়ের ক্রুদ্ধ আক্রোশ। এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান—তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নং ওয়ার্ডের করিডোরে। সাধারণ ওয়ার্ডেও চিকিৎসার জন্যে ঠাঁই মেলেনি। ভর্তি হয়ে করিডোরে ঠাঁই পেয়েছিলো, করিডোরেই শেষ বিদায় নিয়েছে।
আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে। বায়ান্নোর ঝড়ো দিনগুলো। পঞ্চাশের দশক সবে শুরু। এ জেড এম ওবায়দুল্লাহ খান, আনোয়ারুল আজিম, সাত্তার, আমীর আলী, সাখাওয়াত, গোলাম মওলা, ফকির শাহাবুদ্দিন, আবদুল মোমিন, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, শামছুল হক চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, হাবিবুর রহমান শেলী, ইশতিয়াক আহমেদ, ইব্রাহিম তাহা, শামসুল আলম, হাসান হাফিজুর রহমান, নাদিরা রওশন আরা, বাচ্চু, প্রয়াত সামছুন নাহার, সুফিয়া ইব্রাহিম মাহবুব, জামাল জাহেদী, কে জি মুস্তাফা, ফয়েজ আহমদ আমরা সবাই বয়সের দিক থেকে ২০ থেকে ২৪-এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে সকলেই একটি নম্র নিঃশখক পদচারণা।
সেদিনের রাজনীতিতে আজকের মতো সংলাপের প্রশ্নে জোট ছেড়ে অথবা জোট ভেঙে স্বার্থ হাসিলের তাগিদে লাঠিতে ভর করে বঙ্গভবনে তাড়াহুড়ো করে যাবার অবস্থা ছিলো না। (অবশ্য তখন বঙ্গভবনই ছিলো না, ছিলো গভর্নর হাউস। সেখানে মুসলিম লীগ বিরোধী দলের যাতায়াত ছিলো সীমিত বা শূন্য) বিরোধী দল বলতে ছিলো আওয়ামী মুসলিম লীগ; অসংগঠিত এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক। আর কমিউনিস্ট পার্টি যদিও বাহ্যতঃ আইন মাফিক বেআইনী ঘোষিত ছিলো না, তবুও সীমাহীন সরকারী নির্যাতনের মুখে তাঁদের গোপনে কাজ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। (ইলা মিত্রের ওপর বর্বর অত্যাচারের কাহিনী ৫০-এর ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলে খাপরায় গুলি করে রাজবন্দী হত্যা তার স্বাক্ষর।) ছাত্র ফেডারেশনেরও প্রকাশ্য কাজের কোনো সুযোগ ছিলো না। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের কর্মীদের একটি অংশ জনাব শাহ আজিজের নেৃতত্বে মুসলিম লীগ সরকার সমর্থক (তা মুসলিম লীগ সরকারের গণবিরোধী চরিত্র যত বীভৎসই হোক না কেন)। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ তাদের সংগঠন আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের অনুসরণে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে (একান্ত বাধ্য আইনানুগ) আন্দোলনে বিশ্বাসী। কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের চোখের সামনে তখন নির্বাচনের আশার আতা ফলটি ঝুলছে। (দল হিসেবে জিততে না পারলেও অন্ততঃ কয়েকটি আসন তো পাবেন।) আওয়ামী মুসলিম লীগে ব্যতিক্রম ছিলেন দু’জন মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান, সদ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়া মওলানা ভাসানী চিরদিনের বেয়াড়া আর শেখ মুজিব ছিলেন জেলে। আর সাধারণ গণমানুষ—তাঁরা ছিলেন নেতৃত্ববিহীন। মুসলিম লীগের প্রতি তাঁদের যে বিশ্বাস বা মোহ ছিলো তাতে ধরেছিলো বিরাট ফাটল, অথচ বিকল্প নেতৃত্ব তখনো গড়ে ওঠেনি। তারা ছিলেন অসহায়ত্ব এবং বঞ্চনার যন্ত্রণায় যন্ত্রণা-বিক্ষুব্ধ।
মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ এই দুই রাজনৈতিক দলের দলীয় রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে ছিলো এক বিরাট ছাত্র গোষ্ঠী এবং যুব সম্প্রদায়। সামাজিকভাবে এদের চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে ছিলো পরিবর্তনের স্বপক্ষে, গণমানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। একদিকে মুসলিম লীগ সরকারের নিপীড়নমূলক শাসন-শোষণের আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন, ঊনপঞ্চাশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ধর্মঘট, পঞ্চাশের শিক্ষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এদের চেতনাকে শানিত করেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্গনে এরা এদের অবস্থানকে করেছিলো সুদৃঢ়। এই গোষ্ঠীতে আমরা যাঁরা ছিলাম তাঁদের মধ্যে আব্দুল মতিন (রাষ্ট্রভাষা মতিন), আব্দুল মোমিন, হাবীবুর রহমান, রহমান শেলী, মাহবুব জাফর জাহেদী, রুহুল আমীন কায়সার, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ সুলতান, এম. আর আখতার মুকুল, কমরুদ্দীন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, ফকির শাহাবুদ্দীন, জিল্লুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, কে. জি. মুস্তাফা, ওদুদ পাটোয়ারী, কামরুজ্জামান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্বের ছাত্র, আর ফরিদ, সাঈদ, বারী, মিন্টু, আজিম, সাত্তার, সাখাওয়াৎ এবং আমীর ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণদের সারিতে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে তখন আহমেদ রফিক, আব্দুস সালাম, মঞ্জুর, মরহুম গোলাম মওলা, মরহুম আনিস, সাঈদ হায়দার, বদরুল আলম, সরফুল, আজমল, জিয়া হাসান, শাহজাহান হাফিজ, আব্দুল হাই ছিলেন আমাদের সহযোগী বন্ধু। অলি আহাদকে তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে যদিও বি, কম পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করেছিলেন। তা সত্ত্বেও অলি আহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় কাটাতে পারেননি। মধুর রেস্তোরাঁয় প্রায়ই উদয় হতেন। হলগুলোতেও ছিলো তাঁর আনাগোনা। আপোষহীন লড়ুয়া মনোভাবের জন্যে অলি আহাদের তখন একটা বিশেষ পরিচিত ছিলো। মরহুম ইমদাদুল্লাহ তখন সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন।
একান্ন সালেই যুব লীগ গঠন করা হয়। অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান। আব্দুল ওদুদ পাটোয়ারী, ফজলুল হক বি, এস সি, এবং কামরুজ্জামান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যুব লীগের ক্রিয়াকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন। যুব লীগে অলি আহাদ ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং প্রয়াত ইমাদউল্লাহ ও মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়েও যারা সম্প্রদায় বিদ্বেষী ছিলেন না এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য মরহুম ইব্রাহিম তাহা, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, তরিকুল আলম, মোস্তফা কামাল। সুপ্রীম কোর্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদকে দেখে সেদিনের ইশতিয়াককে চেনা যাবে না। পেশোয়ারী ঢং-এ শেলওয়ার পরনে, কুর্তা গায়ে একহারা গড়নের ইশতিয়াক খালি গলায় পঞ্চাশ হাজার জনতার পল্টনের জনসভায় বক্তৃতা করছে কিংবা তিপান্ন সনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আমরা বহিষ্কৃত হবার পর কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ইশতিয়াক নুরুল আমীন সাহেবের বা ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন ঘেরাও করে আমাদের মুক্তি দাবী করছে ( কে, জি, মুস্তাফা এবং আমি তখন ঢাকা জেলে) এবং বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবী জানাচ্ছে, ক্রোধে ফেটে পড়ছে শান্তশিষ্ট ইব্রাহিম তাহা একথা আজ আর অনেকেই সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিন্তু এই ছিলো পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক অবস্থা। চিন্তার ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কাজ করেছি একযোগে এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্যে, বাংলা ভাষার জন্যে, ছাত্রদের সার্বিক মঙ্গলের জন্যে। একজনের বিপদে অন্যজন ঝাঁপিয়ে পড়েছি; চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছি।
রাজনৈতিক আদর্শগত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের পরস্পরের মধ্যে ছিলো পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার বাঁধন। আর তাহারই জন্যে যখন বায়ান্নোর ২৬ জানুয়ারী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব খাজা নাজিমউদ্দীন ঘোষণা করলেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’-আমরা একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলাম।
খাজা নাজিমউদ্দীন সাহেব ছিলেন আশ্চর্য এক ভদ্দরলোক (?)। আটচল্লিশ সালে পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ছাত্র আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পনেরোই মার্চ একটি লিখিত চুক্তি করে অঙ্গীকার করেছিলেন পূর্ববঙ্গের আইন পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে তিনি সুপারিশ করে প্রস্তাব আনবেন। কিন্তু মাত্র এক মাস পরেই তিনি তাঁর এই ওয়াদা খেলাপ করতে কসুর করেননি। আর মাত্র চার বছর বায়ান্নোর ছাব্বিশে জানুয়ারীতেও তিনি তাঁর শরীফ জবানের এবং শরাফতের অমর্যাদা করে জিন্নাহ সাহেবের কায়দায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ ভদ্দরলোকের কেচ্ছা আউরিয়েইবা আর কী হবে? আমরাই তো আমাদের জাতীয় জীবনের প্রসহনের এক চিহ্ন স্বরূপ তাঁকে জাতীয় নেতা হিসেবে (বোধ হয় বিশ্বাসঘাতকতার) জাতীয় সমাধিতে সমাধিস্থ করে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তার সমাধি ভবন তৈরি করছি। কী নিদারুণ প্রসহন! বাংলা ভাষার দাবিকে যিনি নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন তিনি বাঙালীর জাতীয় নেতা!
থাকগে ও কথা। যা বলছিলাম, তাতেই ফিরে আসা যাক। জনাব খাজা নাজিমউদ্দীনের বক্তব্যের প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় একটি সভা হলো বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন জনাব আব্দুল মতিন। আমরা তাঁকে ডাকতাম রাষ্ট্রভাষা মতিন বলে।
৩০ জানুয়ারীর সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের জনাব খালেক নেওয়াজ খাঁন, কিন্তু দেখা গেলো সভা শেষে মিছিল বের করতে তাদের আপত্তি রয়েছে। কিন্তু তবুও জোর করে একটি ছোট্ট মিছিল বের করা হলো। মিছিলটি ফুলার রোড হয়ে বর্ধমান হাউসের (জনাব নুরুল আমীনের বাসভবন) সামনে বিক্ষোভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলো, সেদিনই আন্দোলনের পরবর্তী দিন ঘোষণা করা হলো ৪ ফেব্রুয়ারী। ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হরতালের ডাক দেয়া হলো, দশটায় বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্র সমাবেশ।
৪ ফেব্রুয়ারী পালন করতে গিয়ে আমাদের কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ৩০ জানুয়ারীর অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম ৪ ফেব্রুয়ারীতেও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ মিছিল করার বিরোধিতা করবে। কেননা মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে তাঁরা সংঘর্ষ এড়াতে চায়। তাদের মত ছিলো মিছিল করা, ভাষার দাবিতে সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে যাওয়া ঐ সময়ে হঠকারিতা হবে। (এ ধরনের কথা আজকালও শোনা যায়, তিরাশির চৌদ্দই এবং পনেরোই ফেব্রুয়ারীর সংগ্রামকে নিজেদের ভীরুদাকে চাপা দেবার জন্যে অনেকেইই হঠকারিতা বলতে চান।) বিজ্ঞ সুবিধাবাদীদের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলাম বলেই ৩ ফেব্রুয়ারীর রাতে নিজেদের এক বৈঠকে স্থির করলাম, সভা পরিচালনার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। ফলে ৪ ফেব্রুয়ারীর সকালে ছাত্র সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের নেতারা যখন আমতলায় টেবিল এনে সভাপতির চেয়ার সংগ্রহে ব্যস্ত ততক্ষণে এম, আর, আখতার মুকুল আমার নাম সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করে দিয়েছে; সঙ্গে সঙ্গে কমরুদ্দীন শহুদের সমর্থন এবং আমার ত্বড়িৎ গতিতে (চেয়ারের মায় না করে) টেবিলের ওপর লাফিয়ে উঠে সভাপতি হিসেবে তিন মিনিটের একটি বক্তৃতা এবং মিছিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা। বন্ধুরা সামনে উঠবার আগেই মিছিল গেট দিয়ে বেরোতে শুরু করলো। দশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জঙ্গী মিছিল ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় জমায়েত হলে মতিন সাহেব বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে সারা প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করলেন। ইতিমধ্যে ৩০ জানুয়ারী সন্ধ্যায় যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয় তাঁরাও ২১ ফেব্রুয়ারী প্রদেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতালের ডাক দিলেন। বুদ্ধির খেলায় ৪ ফেব্রুয়ারীতে আমরা জিতে ছিলাম এবং আন্দোলনকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম। ৪ ফেব্রুয়ারী থেকে ২০ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত প্রস্তুতির যে সময়টুকু পাই তা ভালোভাবে কাজে লাগাই আমরা। অলি আহাদ, সুলতান, ইমাদউল্লাহ এবং আমি ঢাকা শহরের এবং নারায়ণগঞ্জের প্রায় প্রতিটি স্কুল কলেজে ছাত্রদের মধ্যে প্রচারের কাজ চালাই। ফজলুল হক হলের ইস্ট ১৮ নং কক্ষে খবরের কাগজে (অন্য কাগজ জোটানো শক্ত ছিলো) পোস্টার লিখতাম। তা আবার নিজেদের লাগাতে হতো। নাদিরা বেগম মেয়েদের হোস্টেল থেকেও কিছু পোস্টার লিখিয়েছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যে আন্দোলন সংঘর্ষমুখীন হলে তার থেকে সরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে পারে তা ৬ ফেব্রুয়ারীতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একমাত্র মওলানা ভাসানী ছাড়া প্রয়োজন বোধে সংগ্রামী কর্মসূচী নেবার জন্যে অলি আহাদের প্রস্তাবকে সেদিন রাজনৈতিক দলের আর কেউ সমর্থন করেননি। সুতরাং ছাত্রদের মধ্যে আমাদের প্রচার এবং আলোচনাকে জোরদার করতে হবে। ২০ ফেব্রুয়ারীর রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠকে আমাদের ধারণা যে অভ্রান্ত এবং প্রস্তুতির কার্যক্রম যে সঠিক ছিলো তা প্রমাণিত হয়।
২০ ফেব্রুয়ারী বিকেলে মুসলিম লীগ সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করার সঙ্গে সঙ্গে যখন বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সমস্ত ছাত্রাবাস প্রতিবাদ মুখ হয়ে উঠলো, যখন ছাত্রদের প্রতিনিধি ফজলুল হক হলের আব্দুল মোমিন এবং মেডিকেল কলেজের আজমল ১৪৪ ধারা ভাঙার স্বপক্ষে ছাত্রদের রায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের রাতের বৈঠকে জানিয়ে দিলেন তখনও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অলি আহাদ, গোলাম মওলা, আবদুল মতিন ও শামসুল আলমের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
আমাদের প্রস্তুতি ছিলো। আমরা জানতাম ১৪৪ ধারা ভাঙার স্বপক্ষে আমাদের বক্তব্য ছিলো সঠিক এবং অভ্রান্ত। রাত একটায় ঢাকা হল এবং ফজলুল হক হলের মধ্যবর্তী পুকুরের পূর্বপাড়ের সিঁড়িতে হাবীবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, এম. আর. আখতার মুকুল, এস. এ বারী এটি, কমরুদ্দীন শহুদ, জিল্লুর রহমান, আবদুল মোমিন, আনোয়ারুল হক খান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীসহ আমরা ১১ জন এক সংক্ষিপ্ত বৈঠক বসলাম। সিদ্ধান্ত হল : ১৪৪ ধারা ভাঙবোই। ২১ ফেব্রুয়ারী আমতলা সভায় আমাকে সভাপতিত্ব করতে হয়, আমি যদি গ্রেফতার হই তবে এম. আর, আখতার মুকুল সভাপতি হবেন। তারও অভাবে কমরুদ্দীন শহুদ হবেন সভাপতি। আর সত্যাগ্রহীদের প্রথম দলের নেতৃত্ব দেবেন হাবীবুরর রহমান শেলী। পরদিন ২১শে। বিশ্ববিদ্যালয় আমতলা। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে আছে অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ। সকালে থেকেই ছাত্রদের মারমুখী ভাব। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্তের পক্ষে ওকালতি করতে এসে শামসুল হক সাহেব ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হলেন। সভা শুরু হলো। সভাপতি হিসেবে প্রথমে শামসুল হক সাহেবকে বক্তব্য পেশের সুযোগ দিয়েছিলাম। ছাত্রদের তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখে তিনি তার বক্তব্য শেষ করতে পারেননি। এরপর মতিন সাহেব বললেন ১৪৪ ধারা ভাঙার স্বপক্ষে। ছাত্র-জনতা সমর্থন জানালেন তাঁকে। সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলাম, ‘১৪৪ ধারা আমরা ভাঙবো। দশজন, দশজন করে শ্লোগান দিয়ে এসেম্বলী হলের দিকে এগিয়ে যাবো।’
ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসে উঠলো ছাত্র-জনতা। আবেগারুদ্ধ বন্যার তোড়ে ভেসে গেলো সুবিধাবাদের রাজনীতি। হাজার কন্ঠে ধ্বনিত হলো : ১৪৪ ধারা ভাঙবোই। সত্যাগ্রহীদের প্রথম দল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন হাবীবুর রহমান শেলী এবং মেডিকেল ছাত্র আজমল। দ্বিতীয় দলে মরহুম ইব্রাহিম তাহা এবং আবদুস সামাদ। তৃতীয় দলে আনোয়ারুল হক খান এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। চতুর্থ দল নিয়ে বেরুলেন ডঃ সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, মরহুম শামসুন্নাহার এবং শাফিয়া। পুলিশ লাঠিচার্জ করলো। ছাত্ররা উত্তর দিলো ইট পাটকেল ছুঁড়ে। কাঁদুনে গ্যাসে অন্ধকার হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন। কিন্তু ছাত্র-জনতার সে কি রুদ্ররোষ। মিছিল করে তারা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভবনের দিকে যাবেই।
বিশ্ববিদ্যালয় গেট দিয়ে বেরুতে না পেরে মধুর রেস্তোরাঁর পাশের ছোট্ট দেয়ার ভেঙে ছাত্রেরা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ঢুকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের গেট দিয়ে বেরুবার চেষ্টা করে। পুলিশ আবার লাঠিচার্জ করে। কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে। নিরস্ত্র মানুষের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর এক খন্ড যুদ্ধ। তারপর এক সময় গুলির আওয়াজ হলো। এগার নম্বর ব্যারাকের পাশের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শেষ বর্ষের ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে লম্বা ছেলেটি বরকত উরুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলো। গুলিতে সালাহউদ্দিনের মাথার খুলি উড়ে গেলো। একটা ১২/১৩ বছরের কিশোর গুলিতে ঢলে পড়লো।
ছাত্র হত্যার এ খবর বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে দোকান পাট বন্ধ হয়ে গেলো। ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে আইন পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করে বেরিয়ে এলেন মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং সতীন সেন; ছাত্রদের সংগ্রামের সঙ্গে তারা একাত্মতা ঘোষণা করলেন। সন্ধ্যায় সান্ধ্য আইন জারী করে সারা শহরে সেনাবাহিনী নামানো হলো। সেই রাতেই মেডিকেল কলেজের ব্যারাকে আজমলের ঘরে বসে আন্দোলন পরিচালনার জন্যে নতুন করে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলো।
২২ ফেব্রুয়ারী। উত্তাল হয়ে উঠলো ঢাকা শহর। সেক্রেটারিয়েটে ধর্মঘট। রেলের চাকা বন্ধ। সারা ঢাকায় হরতাল আর হরতাল। মিছিলের পর মিছিল। মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে শোকসভা হলো। সভাপতিত্ব করলেন মরহুম ইমাদুল্লাহ। বক্তৃতা করলেন, অলি আহাদ। গায়েবী জানাজা হলো। মোনাজাত করলেন মওলানা ভাসানী। মোনাজাতে করুণ আর্তির সঙ্গে বৃদ্ধ জননেতার ক্রুদ্ধ হুংকার। রাস্তায় আবার লক্ষাধিক জনতার ঢল নামলো। কার্জন হলের সামনে লাঠিচার্জ। ভ্রুপেক্ষহীন জনতা। মানুষের সামনে, সদরঘাটে, চকবাজারে, গুলি চললো। কিন্তু নিঃশঙ্ক বিদ্রোহী জনতা।
২৩ ফেব্রুয়ারী রাতে বরকত যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলো সেখানে গড়ে উঠলো ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার। মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমেদ রফিক, সাঈদ হায়দার, মঞ্জুর, বদরুল আলম, গোলাম মওলা, জিয়া হাসান, আবদুল আলীম, শাহজাহান হাফিজ এদের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২/৩শ’ ছাত্রের সহযোগিতায় রাতের মধ্যে শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শেষ হলো।
২৪শে’র সকাল। বন্যার মত মানুষের পা ভেঙে পড়লো শহীদ মিনারের সামনে! সহস্র মানুষের কান্না। অযুত কন্ঠের ক্রুদ্ধ গর্জন। শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়লো ভাষার আন্দোলন।
০০০
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1984.02.17-bichitra.pdf” title=”1984.02.17 bichitra”]