আবদুস ছােবহান বাহিনী
আবদুস ছােবহান বাহিনী (উখিয়া, কক্সবাজার) মুক্তিযুদ্ধকালে কক্সবাজার এলাকায় গঠিত মুক্তিযােদ্ধাদের একটি স্থানীয় বাহিনী প্রতিষ্ঠাতা এবং বাহিনী প্রধানের নামানুসারে এ বাহিনীর নাম হয় আবদুস ছােবহান বাহিনী। অনানারি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুস ছােবহান ১৯৪০ সালে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার হলদিয়া পালং-এর মরিচ্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যােগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ক্রমান্বয়ে হাবিলদার মেজর, নায়েক সুবেদার, সুবেদার, সুবেদার মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৫ই এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের নিজ এলাকা উখিয়ায় চলে আসেন।
উখিয়ায় এসে তিনি মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা, শ্রমিক, কৃষক, সৈনিকদের নিয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তীতে আবদুস ছােবহান তাঁর স্ত্রী, বড় ভাই কেফায়েত উল্লাহ, আলী আকবর, আবদুল বারী মাস্টার ও মুজিব উদ দৌলাসহ বার্মা (মায়ানমার) চলে যান। সেখানে পাকিস্তানি হানাদার। বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি নিজের পরিচয় গােপন করে একজন কৃষক বলে পরিচয় দেন। এখানে তিনি উখিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক ও আওয়ামী লীগনেতা নুরুল ইসলাম চৌধুরী (ঠাণ্ডা মিয়া)-সহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে গােপনে বৈঠক করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শমসের আলম চৌধুরী (উখিয়া), বদিউর রহমান চৌধুরী (উখিয়া), এ কে এম মােজাম্মেল হক (কক্সবাজার), মনিরুল হক চৌধুরী (কক্সবাজার), জাফর উল্লাহ চৌধুরী (উখিয়া), আলী মিয়া চৌধুরী (হােয়াইক্ষ্যং, টেকনাফ), তেজেন্দ্র নাথ বিজয় রায় চৌধুরী (উখিয়া), অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া (উখিয়া), এম কে শামসুল হুদা (চকরিয়া), ডা. শামসুদ্দিন চৌধুরী (সাবেক এমপি, চকরিয়া), নজরুল ইসলাম চৌধুরী (কক্সবাজার), প্রফেসর মােস্তাক আহমদ (রামু) প্রমুখ। বৈঠকে সকলে আবদুস ছােবহানকে নতুন বাহিনী গঠনে সহযােগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
এডভােকেট নূর আহমদ এমএনএ (টেকনাফ) ও ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী এমপিএ (রামু) চেঁকিবুনিয়ায় আবদুস ছােবহানের গােপন বৈঠক এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানিয়ে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদের কাছে চিঠি দিয়ে তাঁকে জানান। তারা বার্মায় আত্মগােপন করে থাকা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ইবিআর) ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর ৯ জন সৈনিককে আবদুস ছােবহানের কাছে পাঠান। এভাবে আবদুস ছােবহান তার বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনীতে কয়েকজন ছাত্র, কৃষক ও চাকরিজীবীও যােগদান করেন। এ বাহিনীতে নিয়মিত সামরিক ও বেসামরিক সদস্যরা ছিলেন। বাহিনী গঠনের পর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শমসের আলম চৌধুরী ৭টি মার্ক থ্রি রাইফেলস ও ৮৫টি গুলি, টেকনাফ উপজেলার হােয়াইক্ষ্যং-এর চেয়ারম্যান আলী মিয়া চৌধুরী ৯টি মার্ক ফোর রাইফেল, ১টি জি থ্রি রাইফেল, ফরেস্ট গার্ড মনির আহমেদ, নজির হােসেনের ছেলে আবুল কাশেম ও মৌলভী ফেরদৌসের ছেলে মকছুদ আহমদ বার্মার বিদ্রোহীদের ৪,৫৫৫টি গুলি আবদুস ছােবহানকে প্রদানের মাধ্যমে এ বাহিনীর অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। এ অস্ত্রগুলাে ছিল বাংলাদেশ ও বার্মা সীমান্তে মাটিতে পোঁতা, যা পরবর্তী সময়ে মাটি খনন করে উদ্ধার করা হয়। এ-সময় আবদুস ছােবহান আহত অবস্থায় ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনিও আবদুস ছােবহানকে যুদ্ধের পরিকল্পনা দেন। বার্মায় অবস্থানকালে হাবিলদার আবদুস ছােবহানের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীতে ছিলেন নুরুল আবছার, রমেশ বড়ুয়া, পরিমল বড়ুয়া, সুনীল বড়ুয়া, মাে. এনামুল হক, মাস্টার ইলিয়াছ মিয়া, নির্মল চন্দ্র দে, নূর আহমদ, অজিত কুমার পাল, যামিনী মােহন শর্মা, কামিনী বড়ুয়া, এস এম জাহাঙ্গীর, মােহাম্মদ সােলাইমান, মনিন্দ্র বড়য়া মনুসহ আরাে অনেকে। এ বাহিনী পার্বত্য জেলা বান্দরবান, লামা, আলীকদম, ঈদগড়, রামু, উখিয়া, মহেশখালী, চকরিয়াসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করে।
আবদুস ছােবহান বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন যুদ্ধ ও অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন- হাবিলদার আব্দুল জলিল (ইপিআর), নায়েক ফয়েজ আহমদ (ইপিআর), নায়েক আব্দুস সালাম (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট), সিপাহি নুরুল ইসলাম গাজী (ইবিআর), সিপাহি আব্দুল খালেক (ইপিআর), সিপাহি এম এ ওয়াহাব রাজা (ইপিআর), সিপাহি মঞ্জুর আলম চৌধুরী (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট), সিপাহি মােহাম্মদ হােসাইন (ইপিআর), আবদুল কাদের (ইপিআর), মােজাফফর আহম্মদ, আব্দু ছােবহান (ইবিআর), সিরাজুল হক রেজা, আবু আহমদ, ল্যান্স নায়েক ছায়েদুল হক (ইবিআর), মােলাম মওলা, সিপাহি রেজাউল করিম (ইবিআর), ছগীর আহমদ, সিপাহি মােহাম্মদ হােসাইন (ইবিআর), লাল মিয়া, ল্যান্স নায়েক আমিনুল হক (ইবিআর), আমির হামজা, সিপাহি ওহাব রাজা (ইবিআর), সিপাহি আবদুল খালেক (ইবিআর), ছরাত আলম, নুরুল ইসলাম বাঙালি, ফিরােজ আহম্মদ, সেকশন কমান্ডার কেফায়েত উল্লাহ, মমতাজ আহম্মদ, সিপাহি সুলতান আহম্মদ (ইবিআর), দুদু মিয়া, আলী আকবর, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, জ্ঞানেন্দ্রলাল বড়য়া, দীপক কুমার বড়ুয়া, কামল হােসেন চৌধুরী, কৃষ্ণ প্রসাদ বড়ুয়া, প্রিয়তােষ পাল, জহিরুল ইসলাম, জালাল কাশেম, নুরুল হক, আবুল কাশেম প্রমুখ। ছাত্র, কৃষক, চাকরিজীবীদের মধ্যে মােহাম্মদ আয়ুব বাঙালি (হ্নীলা, টেকনাফ), নুরুল আমিন সিকদার (হ্নীলা, টেকনাফ), সিরাজুল কবির (হ্নীলা, টেকনাফ), কবির আহমেদ (হ্নীলা, টেকনাফ), পরিমল বড়ুয়া (ভালুকিয়া, পালং, উখিয়া), মধুসূদন দে, জয়সেন বড়ুয়া, খলিলুর রহমান, তেজেন্দ্র মল্লিক, মােহাম্মদ মােস্তফা, লােকমান হাকিম, জাফর আলম (হােয়াইক্ষ্যং, টেকনাফ), রমেশ বড়ুয়া (রামু) প্রমুখ।
আবদুস ছােবহান বাহিনীর গােয়েন্দা শাখায় দায়িত্ব পালন করেন ধনঞ্জয় মােহন ঘােষ (পিতা রাম মােহন ঘােষ, রাজাপালং, উখিয়া), বাদল বড়ুয়া (পিতা ফণীন্দ্র বড়ুয়া, রুমখা পালং, উখিয়া), ছালামত উল্লাহ (পিতা মৌলভী আবদুল জাব্বার, রত্নাপালং, উখিয়া), জাফর আহম্মদ (পিতা আবদুল আজিজ, রত্নাপালং, উখিয়া), এমদাদ আহমদ চৌধুরী (পিতা হাজী রকীব উদ্দিন চৌধুরী, গর্জনিয়া, রামু), নুরুল আমিন (পিতা নুর আহমদ সিকদার, হ্নীলা, টেকনাফ), মােহাম্মদ ইসহাক (পিতা মৌলভী গােলাম আকবর, পালংখালী, ইখয়া), মেজর (অব.) মােহাম্মদ আবু তাহের (পিতা ছৈয়দুর রহমান, রাজা পালং, উখিয়া), জহির উদ্দিন কুতুবী (পিতা শামসুল হক, সােনারপাড়া, উখিয়া), মাে. কলিম উল্লাহ মাস্টার (পিতা আবদুস জব্বার, হ্নীলা, টেকনাফ), কিরণ বিকাশ বড়ুয়া (পিতা বাধন কান্তি বড়ুয়া, ভালুকিয়া পালং, উখিয়া), আলী আহমদ (ওয়ালা পালং, উখিয়া), নুরুল আলম (মরিচ্যা, উখিয়া), পরিমল বড়ুয়া (ভালুকিয়া পালং, উখিয়া), রমেশ বড়ুয়া (রামু), ছৈয়দ আহমদ চৌধুরী (পিতা বদিউর রহমান চৌধুরী, রাজাপালং, উখিয়া), নুরুল হুদা (টেকনাফ) প্রমুখ। রামু উপজেলার উখিয়াঘােণার মােজাফফর আহম্মদ, রামু হাইস্কুলের শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযােদ্ধা ফজল আমিন এ বাহিনীর খবরাখবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এ প্রচারের জন্য প্রেরণ করতেন।
এ বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযােগিতা করেন শমসের আলম চৌধুরী (উখিয়া), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (ঠাণ্ডা মিয়া, উখিয়া), বদিউর রহমান চৌধুরী (উখিয়া), এ কে এম মােজাম্মেল হক (কক্সবাজার), মনিরুল হক চৌধুরী (কক্সবাজার), এডভােকেট নূর আহমদ এমএনএ (টেকনাফ), এডভােকেট জহিরুল ইসলাম (চকরিয়া), ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীএমপিএ (রামু), মােস্তাক আহমদ চৌধুরী এমপিএ (কক্সবাজার), ডা. শামসুদ্দিন চৌধুরী (চকরিয়া), আলী মিয়া চৌধুরী (টেকনাফ), এস কে শামসুল হুদা (চকরিয়া), তেজেন্দ্র বিজয় রায় (রুমখাপালং, উখিয়া), তােফায়েল আহমদ চৌধুরী (রত্নাপালং, উখিয়া), আহমদ হােসাইন (উখিয়া), অধ্যাপক মােহামম্মদ আলী টেকনাফ) প্রমুখ।
৯ই জুন এ বাহিনী গভীর বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পেঁকিবুনিয়া থেকে একটি খাল পার হয়ে সর্বপ্রথম ঘুমধুম এলাকায় প্রবেশ করে। টেকনাফের হােয়াইক্ষ্যং-এর জাফর আলমের মাধ্যমে কিছু অস্ত্র জোগাড় করে ভালুকিয়া পালং হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাইক্ষ্যংছড়ির রেজু মৌজায় যােগেন্দ্র সিকদারের খামার বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এসময় বার্মিজ বিদ্রোহীদের পুঁতে রাখা ৪৫৭১টি গুলি রেজুপাড়া খামারে অবস্থানকালে এ বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া তাঁরা পালং বহুমুখী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, রামু কমিউনিটি সেন্টার এবং কক্সবাজারে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ বাহিনী সােনাইছড়ি গভীর অরণ্যেও অবস্থান করে সােনাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে। সােনাইছড়িতে এ বাহিনীতে আবু আহমদ, নুরুল হক, রমেশ বড়ুয়া প্রমুখ যােগ দেন। এসময় রুমখাপালং-এর বক্তার আহমদ চৌধুরী, রামু খুনিয়াপালংএর চেয়ারম্যান হাছান আলী মাস্টার, রত্নাপালং-এর মৌলানা আব্দুল জব্বার, ধেচুয়াপালং-এর আব্দুর রহিম চৌধুরী প্রমুখ বিভিন্ন অপারেশনে সহযােগিতা করেন। এ বাহিনী কক্সবাজার এবং বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও অপারেশন পরিচালনা করে। এ বাহিনীর কয়েকটি উল্লেখযােগ্য অপারেশন হলাে- জোয়ারিয়ানালা লাল ব্রিজ অপারেশন, ঈদগাঁও লাল ব্রিজ অপারেশন, লামা থানা আক্রমণ, আলীকদম অপারেশন, চকরিয়ার ডুলাহাজারা লাল ব্রিজ অপারেশন, ঈদগাঁও লাল ব্রিজ ২য় অপরারেশন, ঈদগাঁও সেতু ৩য় অপারেশন, ঈদগড় সম্মুখ যুদ্ধ, রামু থানা অভিযান, উখিয়া থানা অপারেশন, মহেশখালী থানা আক্রমণ, পাতা বাড়ি পুরক্ষ্যা ক্যাম্প, বালুখালী রাজাকার ক্যাম্প, চকরিয়া আজিজনগর রাজাকার ক্যাম্প, ধেছুয়াপালং রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও কক্সবাজারে আক্রমণ। জোয়ারিয়ানালা লাল ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ২৮শে আগস্ট। এতে ২ জন পুলিশ ও ১০ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে এবং ২টি ৩০৩ রাইফেল, ৮৫ রাউন্ড গুলি এ বাহিনীর হস্তগত হয়। এটি ছিল কক্সবাজার সাব-সেক্টরে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম সফলঅভিযান। ঈদগাঁও লাল ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ১৭ই সেপ্টম্বর। এতে ২ জন রাজাকারকে আটক করা হয় এবং ৯৫ রাউন্ড গুলি মুক্তিযােদ্ধারা উদ্ধার করেন। ১৫ই অক্টোবর এ বাহিনী অন্য দুটি বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে লামা থানা আক্রমণ করে। এতে ২ জন পুলিশ, ২ জন বিহারি ও ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। ৩৮টি রাইফেল ও ১০,৬৫৯ রাউন্ড গুলি এ বাহিনী হস্তগত করে। লামা থানায় সফল অপারেশনের পর এ বাহিনীর সদস্য ইদ্রিস মােল্লার নেতৃত্বে জহরলাল পাল চৌধুরী, আইয়ুব বাঙ্গালীসহ ১৩ জন মুক্তিযােদ্ধা আলীকদমে অপারেশন চালান। আলীকদমে পৌছে তাঁরা প্রথমেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আলীকদমে অপারেশনে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। চকরিয়ার ডুলাহাজারা লাল ব্রিজ অপারেশন সংঘটিত হয় ২রা নভেম্বর। এ অপারেশনে একজন রাজাকার নিহত এবং ১০১২ জন পুলিশ ও রাজাকার আহত হয়। এ অভিযানে ৩টি রাইফেল ও ১৩০ রাউন্ড গুলি মুক্তিযােদ্ধারা হস্তগত করেন। ঈদগাঁও লাল ব্রিজ ২য় অপরারেশন সংঘটিত হয় ২২শে নভেম্বর। এতে ২ জন পুলিশ ও ৪ জন রাজাকারসহ ৬ জন। নিহত হয় এবং ১০ জনকে আটক করা হয়। এতে ৭টি রাইফেল এবং ৩০০টি গুলি মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। হানাদাররা ব্রিজটি পুনরায় দখল করে নেয় এবং সে এলাকার জনগণের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। পাকহানাদারদের মনােবল ভেঙ্গে দেয়া, অস্ত্র সংগ্রহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থাকে শত্রুসেনাদের কর্তৃত্ব মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ঈদগাঁও ব্রিজে তৃতীয় দফা অপারেশন করে ব্রিজটি শত্রুমুক্ত করা হয়।
২৫শে নভেম্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এ বাহিনীর ঈদগড় সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে ১৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয় এবং ৯ জন আহত হয়। অপরদিকে মুরংপাড়ার মুক্তিযােদ্ধা লা ফ্রে মুরং শহীদ হন এবং কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।
উখিয়ার আবুল কাশেম ও মণীন্দ্রলাল বড়ুয়া (ভট্ট মহাজন) পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে আবদুস ছােবহানের নেতৃত্বে এ বাহিনীর ৩০ জন বাছাই করা দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধা টেকনাফ থানা অপারেশন করেন। এতে ১০ থেকে ১২ জন হানাদার সদস্য হতাহত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধা মঞ্জুর আলম (ইপিআর সদস্য) ও ল্যান্স নায়েক আবদুল খালেক গুলিবিদ্ধ হন।
১১ই ডিসেম্বর অধিনায়ক আবদুস ছােবহান এবং এম এ ওয়াহাব মিয়া রাজার নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা রামু থানায় অভিযান চালান। এতে থানার পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে এবং ৯২টি রাইফেল, ৬,৮৬১ রাউন্ড গুলি ও ৪টি সিভিল গান মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
১২ই ডিসেম্বর এ বাহিনী উখিয়া থানায় অপারেশন করে। অপারেশনে থানার পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে এবং ৮৭ টি রাইফেল, ৪,৭৪০ রাউন্ড গুলি মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। অপারেশনের পর অধিনায়ক আবদুস ছােবহান উখিয়া এলাকাকে মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘােষণা করেন। ১১ই ডিসেম্বর অধিনায়ক আবদুস সােবহান ইপিআর সদস্য ল্যান্স নায়েক আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের মুক্তিবাহিনীর একটি অগ্রগামী দলকে গােপনে মহেশখালী প্রেরণ করা হয়। তাঁরা ছদ্মবেশে মহেশখালীর পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। আবদুস ছােবহানের নেতৃত্বে উখিয়া ও কক্সবাজার থেকে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধার আরেকটি দল মহেশখালীতে পৌছায়। ১৩ই ডিসেম্বর যৌথভাবে মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মহেশখালী থানা আক্রমণ করেন। থানায় অবস্থানরত আলবদর, রাজাকার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পুলিশ বাহিনী পালানাে কিংবা পাল্টা আক্রমণের কোনাে সুযােগ না পেয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। অভিযানে মুক্তিযােদ্ধারা ১৬৬টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও ৭,৪৮৫ রাউণ্ড গুলি উদ্ধার করেন। মুক্তিযােদ্ধারা থানা দখলে নিয়ে মহেশখালীকে হানাদারমুক্ত ঘােষণা করেন।
উখিয়া থানা অপারেশন ও মুক্তাঞ্চল ঘােষণার পর মুক্তিযােদ্ধারা পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। এখান থেকে উখিয়ার সিভিল প্রশাসন পরিচালনা করা হয়। এ-সময় এখান থেকে তাঁরা পাতাবাড়ি পুরক্ষ্যা ক্যাম্প, বালুখালী রাজাকার ক্যাম্প (১৪ই ডিসেম্বর), চকরিয়া আজিজনগর রাজাকার ক্যাম্প (১৪ই ডিসেম্বর) ধেছুয়াপালং রাজাকার ক্যাম্প (১৫ই ডিসেম্বর) আক্রমণ করেন এবং অনেকগুলাে অস্ত্র উদ্ধার করেন।
আবদুস ছােবহানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কক্সবাজারে আক্রমণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে না পেরে হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদররা পালিয়ে যায়। ১২ই ডিসেম্বর অধিনায়ক আবদুস ছােবহানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা একত্রিত হয়ে রাডার স্টেশন ও পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড