বীর প্রতীক আবদুস সােবহান
আবদুস সােবহান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৪) নায়েক সুবেদার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চরলােহনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কালু মিয়া বেপারী এবং মাতার নাম ফজরন নেছা।
আবদুস সােবহান ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তাঁর অবস্থান ছিল যশাের সেনানিবাসে। ৩০শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। আবদুসসােবহানসহ অন্যান্য বাঙালি সেনারা পাকবাহিনীর ঐ হামলা প্রতিরােধে সচেষ্ট হন। এক পর্যায়ে কৌশলে সেনানিবাস থেকে বের হয়ে যশােরের চৌগাছায় ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তাঁরা একত্রিত হন। তারপর ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে আবদুস সােবহান বেনাপােল, পেট্রাপােল, চুয়াডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি জুন মাসে ভারতের তেলঢালায় চলে যান এবং ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হওয়ার পর তাতে যােগ দেন। তেলঢালা থেকে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তিনি মৌলভীবাজার রণাঙ্গনে চলে আসেন। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই বিওপি-র যুদ্ধটি ছিল তাঁর যুদ্ধকালীন সময়ের সবচেযে স্মরণীয় ঘটনা। এটি সংঘটিত হয় ৩০শে অক্টোবর মধ্যরাতে। ইতঃপূর্বে ২৮শে অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বিশাল গ্রুপ ধলই বিওপি আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে এটি দখলের দায়িত্ব পড়ে আবদুস সােবহান ও তাঁদের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে ধলই বিওপি-তে পাকবাহিনী একটি শক্তিশালী দুর্ভেদ্য ঘাঁটি স্থাপন করে। এ বিওপি-র চারপাশে ছিল ছােটছােট টিলা, চা বাগান এবং মাঝে-মাঝে ঘন বাঁশবন। চারদিক কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ছিল। মজবুত বাঙ্কার এবং আশপাশের ভূমিতে মাইন পুঁতে রেখে পাকবাহিনী এ ঘাঁটিটিকে দুর্ভেদ্য করে রাখে। ৩০শে অক্টোবর মধ্যরাতে ধলই বিওপি-তে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ শুরু হয়। আবদুস সােবহান তাঁর সহযােদ্ধাদের নিয়ে বিওপি-র কাছাকাছি গিয়ে অবস্থান নিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেড ছােড়েন এবং একই সঙ্গে তাঁর সহযােদ্ধারা গুলি চালাতে থাকেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে শত্রুপক্ষ প্রথমে হতচকিত হয়ে যায়। পরক্ষণেই তারা মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর বৃষ্টির মতাে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। পাকবাহিনীর আক্রমণে অনেক মুকিযােদ্ধা হতাহত হন। পাকবাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে গুরুতর আহত হন আবদুস সােবহান। তার হাতের একটি আঙ্গুল ও বাম উরুর মাংসপেশী উড়ে যায়। প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যেও সহযােদ্ধারা তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে সীমান্তে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আবদুস সােবহানের অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম আনােয়ারা বেগম। এ দম্পতি ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড