You dont have javascript enabled! Please enable it!

আবু ওসমান চৌধুরী

আবু ওসমান চৌধুরী (১৯৩৬-২০২০) বীর মুক্তিযােদ্ধা, ৮নং সেক্টর কমান্ডার ও কুষ্টিয়া বিজয়ের নায়ক। ১৯৩৬ সালের ১লা জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামের চৌধুরী পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আবদুল আজিজ চৌধুরী এবং মাতার নাম মাজেদা খাতুন। নিজ গ্রামের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ। পার্শ্ববর্তী মানিকরাজ জুনিয়র হাইস্কুলে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে তাঁর নিজ গ্রামের চান্দ্রা ইমাম আলী হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫১ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর লেখাপড়া বিঘ্নিত হয়। ১৯৫৪ সালে চাঁদপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। স্নাতক পাস করার পর একই বছর তিনি অফিসার হিসেবে ঢাকা এয়ারপাের্টে চাকরিতে যােগ দেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগদানের জন্য পরীক্ষা দিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে ৯ মাস ট্রেনিং শেষে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন।
ছাত্রজীবন থেকেই আবু ওসমান চৌধুরী রাজনীতি সচেতন, তবে সাংগঠনিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ভাষা আন্দোলনকালে ঢাকা কলেজে ছাত্র অবস্থায় ৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বের হওয়া এবং পুলিশের গুলিতে ছাত্রহত্যার রক্তাক্ত ঘটনার সময় তিনি অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে সেখানে ছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনে ৬-দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-এর বিপুল বিজয় এবং নির্বাচনােত্তর পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর আচরণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন সংঘাত আসন্ন। অতএব নিজ চেষ্টায় তিনি ৭১-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় আসেন এবং ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) চুয়াডাঙ্গা ৪নং উইং-এর কমান্ডার বা অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ তিনি যুদ্ধপ্রস্তুতির সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেখতে পান। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন, যার শিরােনাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ১৯৪৭-১৯৭১, (চারুলিপি ১৯৯১)। মেজর (মুক্তিযুদ্ধকালে তার র্যাংক) আবু ওসমান চৌধুরী মনে-মনে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া ও নির্বিচার হত্যার খবর পেয়ে পরের দিন ২৬শে মার্চ তাঁর ইউং-এর ৪০০ ইপিআর সদস্য নিয়ে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ, পুলিশ, আনসার ও অন্যান্যদের নিয়ে তিনি বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে কয়েক হাজার জনতার উপস্থিতি ও তাদের মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্যে উইং সদর থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সেখানে নিজ হাতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানান। পদ্মার এ পাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ‘দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন’ ঘােষণা করে তিনি নিজে এর অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ। এ সবের মধ্যে ছিল কুষ্টিয়া দখলদার মুক্তকরণ যুদ্ধ, বিশাখালী যুদ্ধ (১, ৫ই এপ্রিল), লেবুতলা যুদ্ধ, (যশাের, ৭ই এপ্রিল), গােয়ালন্দ যুদ্ধ (১৩ই এপ্রিল), বেনাপােলের যুদ্ধ (ভারতের সীমান্তবর্তী যশাের জেলাধীন, ২৪শে এপ্রিল) ইত্যাদি। এসব যুদ্ধে তৌফিক-ই-এলাহী, মাহবুবউদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক সফিক উল্লাহ এ তিন জনকে যুদ্ধের প্রয়ােজনে বাংলাদেশ হাই কমান্ডের পক্ষে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ফিল্ড কমিশন দিয়ে ক্যাপ্টেন র্যাংক’-এ ভূষিত করেন। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় ১০ই এপ্রিল গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশ্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর উপস্থিত হতে বিলম্ব হওয়ায় মাহবুবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে সরকারের নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। শপথ গ্রহণ শেষে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে এক প্লাটুন ইপিআর সদস্যসহ রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এদিকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্রমাগত বিমান হামলা, ভারী অস্ত্র ও সংখ্যাবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে অপেক্ষাকৃত কম প্রশিক্ষিত জনবল এবং হালকা সীমিত অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে বেশিদিন বিজয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মধ্য এপ্রিল থেকে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানের পতন ঘটে। মেজর ওসমান তাঁর সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুর, ইছাখালী এবং সর্বশেষে বেনাপােল সীমান্তবর্তী স্থানে স্থানান্তরিত করেন। মেজর ওসমানের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য নিহত, বহু আহত, বেশকিছু বন্দি এবং হানাদার বাহিনীর ব্যবহৃত অনেক যানবাহন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গােলাবারুদএবং বেশকিছু যানবাহন মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। এসব যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ও বহুল আলােচিত ছিল কুষ্টিয়া বিজয় যুদ্ধ। ৩০শে মার্চ থেকে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৩ দিন এ-যুদ্ধ চলে। আবু ওসমান বাহিনী তিনদিক থেকে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করে। অফিসারসহ ২০০ জনের মতাে পাকিস্তানি সেনার অধিকাংশ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়। কিছু সংখ্যক আহত অবস্থায় গ্রামের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে জনতার হাতে নিহত হয়। উল্লেখ্য, যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের পেছনে বিপুল সংখ্যক জনতা উপস্থিত থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে চতুর্দিক প্রকম্পিত করে শত্রুদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তােলে। উল্লিখিত এসব যুদ্ধে আবু ওসমান চৌধুরীর অধিনায়কত্বে যারা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, বীর প্রতীক- (স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা), ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম- (স্বাধীনতাপরবর্তী পুলিশ সুপার, বর্তমানে ব্যবসায়ী), ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী, সুবেদার মােজাফফর আহমেদ, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক সফিক উল্লাহ, নায়েব সুবেদার শামসুল হক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
৩০শে মে ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে যশাের সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে এলে মেজর আবু ওসমান তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ও মুক্ত এলাকা ঘুরিয়ে দেখান। মে মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনকে ৮ ও ৯ নম্বর এ দুটো সেক্টরে ভাগ করে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা এবং খুলনা ও ফরিদপুরের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ৯ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব মেজর এম এ জলিলের ওপর অর্পণ করা হয়। কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা ও ফরিদপুর জেলার বাকি অংশ নিয়ে ৮নং সেক্টর গঠিত হয়। এ সেক্টরের দায়িত্ব মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর ওপর ন্যস্ত করা হয়। এর হেডকোয়ার্টার্স ছিল যশােরের বেনাপােল। এ সেক্টরকে ৭টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়, যথা- বয়ড়া, হাকিমপুর, ভােমরা, লালবাজার, ব্যানপুর, বেনাপােল ও শিকারপুর। ১২ হাজার নিয়মিত বাহিনী ও ৮ হাজার অনিয়মিত বা গণবাহিনীর সদস্য নিয়ে এ সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গঠিত ছিল। আগস্টের মধ্যভাগ পর্যন্ত আবু ওসমান চৌধুরী এ সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মেজর মঞ্জুর মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী-র সুপারিশক্রমে সরকার কর্তৃক মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর স্থলে মেজর মঞ্জুরকে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ১৮ই আগস্ট সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মেজর মঞ্জুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপরদিকে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে ক্লোজ করে কর্নেল ওসমানীর সেনা সদর দপ্তরে গুরুত্বহীন দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক সেনা সদস্যের পদোন্নতি বা র্যাংক পরিবর্তন হলেও মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিস্বরূপ কোনাে পদকও তাঁকে দেয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল ‘সিনিয়রদের হুকুম পালন না করা বা সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা’। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে অভিযােগ অসত্য প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে লে. কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে আগাম অবসরে পাঠান। লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর জীবনে একটি গভীর ট্র্যাজেডি হলাে, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সৈনিকদের গুলিতে তাঁর জীবনসঙ্গিনী বেগম নাজিয়া ওসমানের করুণ মৃত্যু। তিনি ২০২০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র : লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, চারুলিপি ১৯৯১; লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ ও আমার কিছু কথা’, ফরিদগঞ্জ থানা সমিতির অনুষ্ঠানে ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ পঠিত প্রবন্ধ; ২০১৮ সালের ২৮শে জুন লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!