You dont have javascript enabled! Please enable it! স্থানীয় মুক্তিবাহিনী আবদুল জলিল বকসু গ্রুপ - সংগ্রামের নোটবুক

আবদুল জলিল বকসু গ্রুপ

আবদুল জলিল বকসু গ্রুপ (সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। ১ নং সেক্টরের অধীন ভারতের হরিণা ক্যাম্পে এটি গঠিত হয়। এর কমান্ডার ছিলেন আবদুল জলিল বকসু (পিতা তজু মিয়া, কালিয়াইশ, সাতকানিয়া)। গ্রুপটি গঠিত হওয়ার পূর্বে এ গ্রুপের সদস্যরা আরাে অনেকের সঙ্গে প্রথমে দেমাগ্রি মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভারতের ৩১ জাঠ রেজিমেন্টের কর্নেল নন্দলাল সিং, কর্নেল বাজুয়া, কর্নেল বেল সিং, মেজর নাগ্রা সিং ও সুবেদার মেজর রাজু হালদারের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। রাজু হালদার ছিলেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সুপারভাইজার। চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী সরকারি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মৃণাল কান্তি বড়ুয়া এ ক্যাম্পে চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন। তিনি প্রশিক্ষণার্থীদের রিক্রুটমেন্টের সময় শারীরিক পরীক্ষার কাজ করতেন।
প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে দেমাগ্রি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীদের নানা গ্রুপে ভাগ করা হতাে। প্রতিশ্রুপে একজন করে কমান্ডার থাকতেন। যেমন, চন্দনাইশ উপজেলার হারলা এলাকার সিরাজুল ইসলাম রহমানী (পিতা মােখলেসুর রহমান) একটি গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন। এ গ্রুপের অন্যরা হলেনচন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীর প্রভাষ চন্দ্র দাশগুপ্ত (পিতা সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত), রাখাল চন্দ্র দাস (পিতা তেজেন্দ্র লাল দাস), মদন মােহন দাস (পিতা কিষ্ট চন্দ্র দাস), সুধীর কান্তি দাস (পিতা প্যায়ারি মােহন দাস); সাতকানিয়া উপজেলার মাইঙ্গাপাড়ার উমর আলী, একই উপজেলার ফকিরখীলের পিন্টু দাশগুপ্ত, কাটগড়ের হরিমােহন জলদাস, আনােয়ারা উপজেলার বটতলের আবদুল মন্নান প্রমুখ। প্রশিক্ষণ চলাকালে গ্রুপসমূহের সদস্যদের বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে হতাে। যেমন, একাধিক গ্রুপের প্রায় ১২০ জন সদস্য সিরাজুল ইসলাম রহমানীর নেতৃত্বে ছােট হরিণা, বড় হরিণা, বরকল, কর্ণফুলী নদী ও বড় হরিণাসংলগ্ন একটি স্থানে মােট ৫টি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন।
দেমাগ্রি ক্যাম্পে ৩০৩ রাইফেল, মার্ক-০৪ রাইফেল, ৩৬ কার্বন মেশিনগান, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি, ২ ইঞ্চি মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড, মাইন, বিস্ফোরক, প্রােপাকান্ডা প্রভৃতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা লুংলাই ও আইজল হয়ে মাইনকার চরে পৌঁছান। সেখানে তাঁদের কুড়িগ্রাম এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হলে ১১ নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরের নিকট তাঁরা অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তারা জানান, কুড়িগ্রাম তাঁদের কাছে অপরিচিত এলাকা। অপরিচিত এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ করা কঠিন। কর্নেল আবু তাহের তাঁদের কথায় ক্ষুব্ধ হন। এরপর ভারতীয় এক ব্রিগেডিয়ারসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী মাইনকার চর ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে এ ঘটনা জানতে পারেন এবং নির্দেশ দেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনিয়মিত যােদ্ধারা নিজেদের পছন্দমতাে এলাকায় অংশ নিতে পারেন। তবে সরকারি বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত ইপিআর, আনসার ও পুলিশ সদস্যরা নির্দেশ অনুসারে অংশ নেবে। অতঃপর তাঁদের হরিণা ক্যাম্পে প্রেরণ করা হলে সেখানে তাদের থেকে ৩০-এর অধিক সদস্য নিয়ে ১৫৩ নং আবদুল জলিল বকসু গ্রুপ এবং অন্য সদস্যদের নিয়ে আরাে দুটি গ্রুপ গঠন করা হয়। এ তিন গ্রুপকে শপথবাক্য পাঠ করান বি এম ফয়েজুর রহমান এমপিএ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা স্বপন কুমার চৌধুরী। ৭ই ডিসেম্বর ১৫৩ নং গ্রুপ অন্য দুগ্রুপের সঙ্গে চন্দনাইশ উপজেলার জঙ্গলহাশিমপুরস্থ দেওয়ানজীর খিল এলাকায় পৌঁছে সেখানকার আলী হােসেন মাস্টারের কৃষিখামারে অবস্থান নেয়। তখন প্রায় ভাের। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, চন্দনাইশ উপজেলার জামিজুরি এলাকার উত্তর পাশের রেলব্রিজ মাইন দ্বারা উড়িয়ে দিয়ে দোহাজারী-জামিজুরি এ রহমান উচ্চ বিদ্যালয় রাজাকার-মুজাহিদ ঘাটিতে আক্রমণ করা। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাদের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রায় পৌনে ৪ ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে লােহাগাড়া উপজেলার সুভাষ মজুমদার (পিতা ক্ষিতীশ মজুমদার) এবং সাতকানিয়া উপজেলার বিমল কান্তি চৌধুরী (পিতা সুধাংশু বিমল চৌধুরী) নামক দুজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। তারা ১৫৩ নং গ্রুপের সদস্য এবং এলএমজিম্যান ছিলেন। ভয়াবহ এ-যুদ্ধ স্থানীয়ভাবে দেওয়ানজীর খিল- যুদ্ধ নামে পরিচিত।
১৫৩ নং গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- আবদুল জলিল বকসু (কালিয়াইশ, গ্রুপ কমান্ডার), রঞ্জিত কুমার দাশ, নিরঞ্জন বিহারী নাথ, অজিত মজুমদার, বাবুল কান্তি মজুমদার, অরুণ কান্তি মজুমদার, রামধন নাথ, কাজল কান্তি বিশ্বাস, আদিনাথ মজুমদার, আনু মিয়া, হিমাংশু বিমল দাশ, হরিমােহন দাস, রাম গােপাল দাস, অনিল দাশ, বাবুল কান্তি দত্ত, রাখাল কৃষ্ণ দত্ত, বিধুর চন্দ্র দাস, নির্মল কান্তি দাস, বসন্ত দাস, প্রফুল্ল মােহন নাথ, সুনীল দাস, পুলিন দাস, নেপাল কান্তি দাস, নারায়ণ দাস, মেঘনাথ পাল, মিলন চক্রবর্তী, পরিমল কান্তি দাস, মাে. আবুল হােসেন, পরিমল মজুমদার, রঞ্জিত মল্লিক, বিমল কান্তি চৌধুরী (পিতা সুধাংশু বিমল চৌধুরী, সাতকানিয়া), সুভাষ মজুমদার (পিতা ক্ষিতীশ মজুমদার, লােহাগাড়া, চট্টগ্রাম), মাহাবুব আলম চৌধুরী এবং পরিমল বড়ুয়া। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড