You dont have javascript enabled! Please enable it! বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুল মালেক উকিল - সংগ্রামের নোটবুক

আবদুল মালেক উকিল

আবদুল মালেক উকিল (১৯২৪-১৯৮৭) বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ১৯২৪ সালের ১লা অক্টোবর নােয়াখালী জেলার সদর উপজেলাধীন ৮নং এওজবালিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা মােহাম্মদ মুন্সী চাঁদ মিয়া ও মাতা নুরুন নেছা। তিনি নােয়াখালী আহমদিয়া হাই মাদ্রাসা থেকে অংকে লেটারসহ জেনারেল স্কলারশিপ নিয়ে হাই মাদ্রাসা পাস করেন। তারপর কিছুদিন কলকাতায় অধ্যয়ন শেষে ১৯৪৭ সালে তিনি যশােরের মাগুরা কলেজ থেকে আইএ, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯৫০ সালে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সলে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করে আইনজীবী হিসেবে নােয়াখালী বার এবং ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাই কোর্টে যােগ দেন। আবদুল মালেক উকিল ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলা, বিহার ও আসামের বিভিন্ন স্থানে প্রচারকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মহান ভাষাআন্দোলন-এর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ এবং ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন তিনি কারাভােগ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগপ্রতিষ্ঠার সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
আবদুল মালেক উকিল ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগ-এ যােগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি নােয়াখালী সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন পরিচালনা করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচনে (যুক্তফ্রন্টের মজিবুর রহমান মােক্তারের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়) আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি ‘মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থাধীনে প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত এবং সংসদে নিজ দল আওয়ামী লীগ ও বিরােধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বাের্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি নিজে নােয়াখালী-৪ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল মালেক উকিল বৃহত্তর নােয়াখালীর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সর্ব দলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে তিনি জানতে পারেন যে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পরদিন ২৬শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে নােয়াখালীর জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার বার্তাটি স্থানীয় নেতাদের কাছে পৌছে দেন। এরপর নােয়াখালী সার্কিট হাউসে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের সকল এমএনএ, এমপিএ, বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। উক্ত সভায় আবদুল মালেক উকিল সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি হিসেবে তিনি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
নােয়াখালীর সর্বস্তরের জনগণ, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সকলে সম্মিলিতভাবে ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত নােয়াখালীতে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। ২৩শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী নােয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌরাস্তায় টেকনিক্যাল হাইস্কুলে ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে নােয়াখালী দখল করে নেয়। এর আগেই ২২শে এপ্রিল আবদুল মালেক উকিল সীমান্ত অতিক্রমণ করে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতে গিয়ে তিনি মুজিবনগর সরকার-এর সঙ্গে যােগাযােগ করে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও নেপাল সফর করে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করেন। এছাড়াও তিনি ভারতের বিভিন্ন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের খবরাখবর নেন এবং তাদের সহযােগিতা প্রদান করেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে ১৭ই নভেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ বিশেষ করে নােয়াখালী অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা যােগায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথমে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী (১৯৭২১৯৭৩), এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭৩-১৯৭৪) ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। এ বছরই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। বৃহত্তর নােয়াখালীর জনহিতকর কাজের মধ্যে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, জেনারেল হাসপাতাল, মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাঁধের হাট, এ এম কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা ও রাস্তা তাঁর অবদানের স্মৃতি বহন করছে। বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ ১৯৮৭ সালের ১৭ই অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মাইজদী কোর্ট বিল্ডিং-এর দক্ষিণে বায়তুল আমান (কোর্ট বিল্ডিং মসজিদ সংলগ্ন) মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। [মাে. ফখরুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড