You dont have javascript enabled! Please enable it! শহীদ বীর মুক্তিযােদ্ধা আবদুল হামিদ - সংগ্রামের নোটবুক

আবদুল হামিদ

আবদুল হামিদ (১৯৫০-১৯৭১) ছাত্রলীগ নেতা ও শহীদ বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালের ৪ঠা মার্চ কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বমু বিলছড়ি ইউনিয়নের বমু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল ফাত্তাহ মাস্টার, মাতার নাম গুলফরাজ খাতুন। তিনি চকরিয়ার ইলিয়াশ জমিলা বেগম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১ম বিভাগে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে ১০ম স্থান অধিকার করে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭১ সালে তিনি একই কলেজে বিকম (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। ৩রা মার্চ তাঁর অনার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করলে পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।
কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় দুর্দান্ত সাহসী আবদুল হামিদ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮-৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনীর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিরােধযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর পরিবারের সদস্যদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি অপর ১৩ জনকে সঙ্গে নিয়ে ১৮ই মে লামা হয়ে ভারতে যান।
গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে পাহাড়ের পর পাহাড় বেয়ে প্রায়। ১০ দিন পর আবদুল হামিদের দলটি ভারতের মিজোরাম প্রদেশের দেমাগ্রীতে পৌছায়। সেখান থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সদস্যদের সহায়তায় তারা লংলাইয়ের সামরিক ক্যাম্পে পৌছেন। এ ক্যাম্পে প্রায় এক মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে আবদুল হামিদের নেতৃত্বে দলটি চকরিয়ায় ফিরে আসে। এরপর আবদুল হামিদের নেতৃত্বে আরাে কিছু সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি স্থানীয় দল গঠন করা হয়। আবদুল হামিদ এ দলের কমান্ডার ছিলেন। তাঁর এ বাহিনী আবদুল হামিদ বাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নজির আহমদ এ দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন। এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী (পরবর্তীতে ম্যানেজার, রূপালী ব্যাংক), মােজাম্মেল হক, মােহম্মদ ইউনুছ, আনােয়ার হােসেন, এনামুল হক (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), সন্তোষ, সুনীল, বেলাল, অমূল্য, শ্ৰীমন্ত, অনীল, ধনঞ্জয় দাশ, দুলাল, এস এম কামাল, আবু তাহের, রমজান আলী বাহাদুর, আমির হামজা, শাহাদাৎ হােসেন, নুর হােসেন, সিরাজুল ইসলাম, সাইয়ং মুরুং, সাধন, জয়নাল আবেদীন, মােহাম্মদ মুসা, লামা উপজেলার মুসা (যড়ষন্ত্র করে হানাদারদের সঙ্গে যােগসাজশের মাধ্যমে সে আবদুল হামিদকে ধরিয়ে দেয়), নুর মােহাম্মদ প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে লামা, আলীকদম ও চকরিয়ায় অনেকগুলাে সফল অভিযান পরিচালনা করে।
১৫ই অক্টোবর লামা থানা অপারেশন শেষে পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বাঁশখালীর সুলতানুল কবির চৌধুরীর (স্বাধীনতাপরবর্তী আওয়ামী লীগ মনােনীত জাতীয় সংসদ সদস্য) সঙ্গে আজিজনগরে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে আবদুল হামিদ পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। আহত অবস্থায় মা-এর সেবা পেতে বাড়িতে আসেন। এসময় হানাদার বাহিনী আবদুল হামিদকে আটক করার জন্য নানা ফাঁদ পাতে। এদিকে তার সঙ্গে ভারতের দেমাগ্রী থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা লামা থানার পােস্ট মাস্টারের ছেলে মুসা কৌশলে সবার অলক্ষ্যে দলত্যাগ করে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর মেজর (অব.) আমিরুজ্জামানের সঙ্গে অবস্থান করতে থাকে। বিশ্বাসঘাতক মুসা তাঁকে হানাদারদের নিকট ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে।
মুসা ও মেজর জামানের সহযােগিতায় পুরিক্ষা বাহিনী ৩রা নভেম্বর গভীর রাতে হামিদের বাড়ি ঘেরাও করে। অনেকটা অসহায়ের মতাে অকুতােভয় বীর মুক্তিযােদ্ধা হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হন। এ-সময় হানাদাররা তার বড়ভাই সহকারী শিক্ষক মৌলভী তমিজ উদ্দিন ও ভগ্নিপতি আজমল হােসেনকেও আটক করে। লামা হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে তাদের একদিন রেখে পরদিন লামা থেকে কাকারার পথ দিয়ে চকরিয়া নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে সুবেদার বেনারসের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাড়ে সী বীচ রেস্ট হাউজে বন্দিদের ইনচার্জ ক্যাপ্টেন আসিফ রিজভীর কাছে হামিদসহ অন্য বন্দিদের হস্তান্তর করা হয়। সী বীচ রেস্ট হাউজে ক্যাপ্টেন আসিফ রিজভীর নির্দেশে পেছনে হাতমােড়া অবস্থায় আবদুল হামিদের ওপর চরম নির্যাতন চালানাে হয়। তারা ভবনের ছাদের লােহার আংটায় তাঁর দু পা আটকিয়ে মাথা নিচু করে ঝুলিয়ে রেখে একটানা বিভিন্ন অঙ্গে নির্যাতন করতে থাকে। ৪ঠা নভেম্বর থেকে ১৮ই নভেম্বর পর্যন্ত টানা ১৫ দিন আবদুল হামিদের শরীরের প্রতিটি স্থানে নির্যাতন চালিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। তাঁকে রােজা রাখার সুযােগ তাে হায়েনারা দেয়ইনি, এমনকি আহার পর্যন্ত দেয়নি। শরীরের বিভিন্ন স্থানে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা দেয়া হয়। কিন্তু নির্মম নির্যাতন সত্ত্বেও আবদুল হামিদ মুখ খােলেননি। সম্ভব সবরকম নির্যাতন চালিয়েও কোনাে তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব না। হওয়ায় হানাদাররা আরাে ক্ষীপ্ত হয়।
পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতনে বিধ্বস্ত আবদুল হামিদকে ১৮ই নভেম্বর হত্যা করার জন্য টেকনাফ নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জনৈক এমদাদ ড্রাইভারের গাড়িতে ওঠানাে হয়। কিন্তু গাড়ি বিকল হওয়ায় অন্য গাড়িতে পিছমােড়া বাঁধা অবস্থায় টেকনাফের সড়ক ও জনপথ বিভাগের বাংলােতে নেয়া হয়। সেখান থেকে হানাদার বাহিনী তাঁকে রেস্ট হাউসের পশ্চিমে পাহাড়ের ঢালুতে পল্লানপাড়া বধ্যভূমিতে নিয়ে যায়। আবদুল হামিদের মাথা কাষ্ঠখণ্ডের ওপর রেখে বারবার আঘাত করে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
৬ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় হানাদার বাহিনীর সুবেদার বেনারস ও তার কয়েকজন সহযােগী। কক্সবাজার বিমান বন্দরে নিহত হয় এবং ক্যাপ্টেন আসিফ রিজভী বার্মায় পালিয়ে যায়।
১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর হামিদের সহােদর ব্যাংক কর্মকর্তা এজাহার হােসাইন ছুটে যান ছােট ভাইয়ের লাশের সন্ধানে। সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধা ইদ্রিস মােল্লা ও তাঁর দলের আরাে কিছু সদস্য। তাঁরা হানাদারদের দোসর লালু মেম্বারকে নিয়ে টেকনাফের পল্লানপাড়া বধ্যভূমিতে ছুটে যান। বধ্যভূমিতে অগণিত লাশের স্কুপের মধ্যে খয়েরি পাঞ্জাবির চিহ্নসমেত একটি লাশ পান, যার কোনাে হালসুরত ছিল না। এটিই ছিল আবদুল হামিদের লাশ। মস্তকবিহীন হাড্ডিসার কঙ্কালের সঙ্গে কিছু মাংসপিণ্ড শুকিয়ে জড়িয়ে ছিল। একমাত্র খয়েরি পাঞ্জাবির চিহ্ন ধরে এবং দৈহিক অবয়ব অনুমান করে আবদুল হামিদের লাশ শনাক্ত করা হয়। ২৪শে ডিসেম্বর জুমার নামাজের পূর্বে চকরিয়ার কাকারস্থ শাহ সুফি হযরত শাহ ওমর (রা.)-এর মাজার সংলগ্ন মাঠে হাজার-হাজার শােকাহত মানুষের অংশগ্রহণে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর শহীদ আবদুল হামিদের অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতিসৌধে লেখা আছে, ‘যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ’।
শহীদ আবদুল হামিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বমুর পাইনাসার বিলে স্থাপিত হয়েছে ‘শহীদ আবদুল হামিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়’, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে নির্মিত হয়েছে শহীদ আব্দুল হামিদ ছাত্রাবাস, কক্সবাজারের চকরিয়া কলেজে নির্মিত হয়েছে ‘শহীদ আব্দুল হামিদ ছাত্রাবাস’, ‘শহীদ আব্দুল হামিদ পাঠাগার’। কক্সবাজারে স্থাপন করা হয়েছে শহীদ আব্দুল হামিদ পাবলিক লাইব্রেরি, চকরিয়ার পৌর বাস টার্মিনালের নামকরণ করা হয়েছে ‘‘শহীদ আব্দুল হামিদ পৌর বাস টার্মিনাল’। আব্দুল হামিদের নিজ গ্রাম বমু হয়ে গজালিয়া, লামা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ আব্দুল হামিদ সড়ক’। এছাড়া সিকলঘাট (জিদ্দা বাজার) শাহ ওমর (রা:) মাজার হয়ে মানিকপুর, চকরিয়া, কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ তাঁর নামে করা হয়েছে। [জগন্নাথ বড়য়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড