You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.19 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | একটি শুভ পদক্ষেপ | আবার পাটের গুদামে আগুন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৯শে জানুয়ারী, শনিবার, ১৯৭৪, ৫ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

একটি শুভ পদক্ষেপ

বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য পরিচালক ঢাকার ৬১টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে এক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাপড়, সিমেন্ট, শিশু খাদ্য, উল, নারিকেল তেল ও লোহার আমদানীকারকও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত নভেম্বর মাসেই এ সকল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। যে সকল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে কাপড়ের ডিলার তেরোটি, ইস্পাত ও লৌহজাত দ্রব্য সাতটি, শিশু খাদ্যের আটটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, উলের এগারোটি প্রতিষ্ঠান ও কিছু সংখ্যক সাইকেল, সিমেন্ট ও নারিকেল তেলের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বাণিজ্য পরিচালনা দপ্তর কর্তৃক গৃহীত এ ধরনের পদক্ষেপে আমরা আশাবাদী। বাণিজ্য বিভাগে যে দুর্নীতি বহুদিন ধরে চলে আসছে তা যেমন উদ্বেগের কারণ তেমনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই দপ্তরটির ভবিষ্যত সম্পর্কেও আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রযেছে। বস্তুতঃপক্ষে দেশের এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বাণিজ্য বিভাগ। বাণিজ্যের সাধুতার উপর দেশের উন্নতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। দেশ স্বাধীন হবার থেকে এই বিভাগে সবচাইতে বেশী দুর্নীতি ও অসাধু পন্থার উদ্ভব হয়েছিল। সরকার বাণিজ্য বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি দমন করতে সক্ষম হননি। আজো এ দুর্নীতির শেষ হয়নি। ব্যবসায়ীরা অসৎপথে উপার্জন করে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছে। সরকার সেই অসৎ ব্যবসায়ীদের উৎখাত করতে পারেন নি। অথচ বাণিজ্যের দুর্নীতির জন্যে দেশের কোটি কোটি মানুষ দুর্ভোগ পোয়াচ্ছে। আমরা পূর্বেও বহুবার এ সকল দুর্নীতির মূলোৎপাটনের জন্যে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি।
আমরা অতীতে দেখেছি এইসব ভুয়া পারমিট ও লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের কল্যাণে কিভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নিরীহ জনসাধারণকে। এখনো যে অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমন নয়। এখনো ভুয়া ব্যবসায়ীদের কল্যাণে এক টাকার জিনিস দশ টাকায় কিনতে হয়।
এ কথা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা মেটানোর জন্যে বিদেশ থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র আমদানীর লাইসেন্স দিয়েছেন। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও খরচ হচ্ছে। অথচ যাদের জন্যে জিনিসপত্র আমদানী করা তারাই যদি না পায় তাহলে আমদানীর সার্থকতা কোথায়? সাম্প্রতিককালে যে ৬১টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা শুভ উদ্যোগ হলেও আমরা মনে করি এটাই যথেষ্ট নয়। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ব্যবসায়ীরা ‘যাহা ইচ্ছা তাহা’ করে চলেছে। আমরা এর আশু নিয়ন্ত্রণ চাই। ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপের উপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হোক। কোনো অঞ্চলের দ্রব্য ঢাকায় অথবা চট্টগ্রামে বিক্রি করে দিলে তার জন্যে কোনো ব্যবস্থা ইতিপূর্বে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা এ ধরনের কার্যকলাপের আশু নিয়ন্ত্রণ চাই। সরকার ব্যবসায়ীদের বলগাহারা মুনাফা অর্জনের পথ বন্ধ করে একটি সুষ্ঠু ব্যবসায়িক নীতির প্রচলন করুন এটাই আমাদের কামনা।

আবার পাটের গুদামে আগুন

গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের আনোয়ারা জুট মিল এবং মাসুদ জুট কর্পোরেশনের ১০টি পাটের গুদাম আকস্মিক ও ভয়াবহ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়। এর মধ্যে মাসুদ জুট কর্পোরেশনের ৫টি গুদামে ৮০ হাজার মণ কাঁচা পাট ছিল। যার আনুমানিক মূল্য হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। অন্য জুট মিলের পাটের হিসেব না জানা গেলেও তা যে উল্লেখযোগ্য একটা পরিমাণেরই হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত এ দু’টি প্রতিষ্ঠানেরই স্থানীয় কর্মকর্তারা পলাতক রয়েছে বলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ জানিয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, এমন ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড এই প্রথম নয়। গত বছরের ২৯শে অক্টোবর আদমজীর ২ নং মিলে আগুন লেগে প্রায় ৩ লাখ টাকার পাট পুড়ে যায় এবং ঐ মাসেরই প্রথম সপ্তাহে ৭ই অক্টোবর আদমজীর ৩ নং মিলে আগুন লেগে আনুমানিক পয়ত্রিশ হাজার টাকা মূল্যের পাট সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়।
ডিসেম্বর মাসেও কিছু পাটের গুদামে আগুন লাগে। ৬ই ডিসেম্বর আদিল জুট মিলে আগুন লেগে বেশ ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ১২ই ডিসেম্বর আমিন জুট এজেন্সীর গুদামে ভয়াবহরূপে আগুল লেগে প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকার পাট ভস্মীভূত হয়ে গেছে। গোডাউনে প্রায় ৭ হাজার ৭শ’ ৬৫ মণ পাট ছিল এবং সব পাটই পুড়ে যায় বলে খবরে প্রকাশ পেয়েছিল। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ভেড়ামারায় এক অগ্নিকান্ডের ফলে প্রায় ৯০ হাজার টাকার পাট পুড়ে যায়। ঐ সপ্তাহেই ২১শে ডিসেম্বরে আবার আদমজী চটকলের ৬ নং জেটিতে একটি পাটের নৌকায় আগুন লেগে প্রায় ৭শ’ ২০ মণ পাট ভস্মীভূত হয়ে যায়।
এরই প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় যে, অক্টোবর মাসের অগ্নিকান্ডের পরে মিল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সে সম্পর্কে জরিপ কার্য পরিচালনার জন্যে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের নিকট আবেদন করা সত্ত্বেও সেখানে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত কোনো সার্ভেয়ার পাঠানো হয়নি। এমন কি সে ব্যাপারে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা দিয়ে কোনো প্রতিবেদন পর্যন্ত পেশ করা হয়নি গত বছরে শেষ দিন পর্যন্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আগুন লাগাটা দুর্ঘটনা বলেই যদি ধরা যায়, তবে তারও তো একটা সরেজমিন তদন্ত হবে। এই আকস্মিক অগ্নিকান্ড কেনই বা সংঘটিত হয় আর কি করেই বা এত দীর্ঘক্ষণ আগুন স্থায়ী হয় এবং এত বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়ে যায়—এ অনুসন্ধিৎসা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে জাগে। আমাদের দেশের মতো একটা গরীব ও গঠনোন্মুখ দেশ এত ঘন ঘন বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির ধাক্কা কি করেই বা সামলাবে সে কথাও আমরা ভাবি বৈ কি! আর ভাবি বলেই এ প্রশ্নের একটা সদুত্তর আশা করার আমরা।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের তালিকা প্রদানে মিল কর্তাদের একটা বিশেষ মহল এবং সাধারণ বীমা কোম্পানীর উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সামগ্রিক ব্যাপারটা আমাদের চোখে ঘোলাটে হয়ে দেখা দিচ্ছে এবং আমরা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠছি। তবে কি এ আদৌ আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়?
এরই প্রেক্ষিতে পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও অপরিসীম। কারণ যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে নানা সমস্যা আছে এবং আরও বহুদিন থাকবে এ সত্য মেনে নিয়েই আমরা দেশগড়ার ব্রত নিয়েছি। তাই নানাবিধ কারণ ও পরিবহন অসুবিধা হেতু এমনিতেই বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সম্পদ পাটের বড় দুর্দিন যাচ্ছে। এই পাট তথা সোনালী আঁশের সম্পদে আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ এবং একমাত্র পাটশিল্পের উন্নতি করতে পারলেই জাতীয় অর্থনীতির মানে বিপুল পরিবর্তন দেখা দেবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
এক্ষেত্রে পাটকে কেন্দ্র করে এদেশের পাটশিল্পকে নস্যাৎ করে দেবার পরিকল্পনা যদি কতিপয় দুষ্কৃতিকারীর থেকেই থাকে তবে তা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের মাটিতে বসবাস করে সে দেশেরই সম্পদ হননে নিত্যতৎপর তারা যেই হোক—তাদেরকে চিহ্নিত করতেই হবে। কারণ দেশীয় সম্পদের শত্রু যারা—তারা দেশেরও চরম শত্রু।
তাই দ্বিবিধ ভূমিকা নিয়ে পাট মন্ত্রণালয়কে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। প্রথম—পাটকেন্দ্রিক চক্রান্ত ও নাশকতামূলক কাজ-কর্মের আশু তদন্ত ও বিচার করা, দ্বিতীয়, যেহেতু পাটে আগুন সহজেই লাগে—তাই গুদামের পাট সংরক্ষণ স্বার্থেই কাছাকাছি অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খবরের সূত্রে বলা হয়েছে যে, দমকল বাহিনী আসতে বিলম্ব ঘটায় এত ক্ষতি হতে পেরেছে। পরিশেষে, আমাদের সংশ্লিষ্ট পাট মন্ত্রণালয়কে তাদের দায়িত্বে সজাগ হতে এবং পাটকেন্দ্রিক সকল নৈরাজ্য এবং প্রায় উদ্দেশ্যমূলক নানা অগ্নিকান্ডের গোপন রহস্য দূর অবশ্য করণীয় কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন