আফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতাল (ভালুকা, ময়মনসিংহ)
আফসার বাহিনীর যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ডা. ওয়াইজউদ্দিন আহমেদের পরিচালনায় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল হিসেবে এর যাত্রা শুরু। পরে বাসাইল উপজেলার কালমেঘা গ্রাম থেকে এটি স্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালাতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ভালুকা থানায় স্থানান্তরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে ৫-৬শ মুক্তিযােদ্ধা এখান থেকে চিকিৎসা সেবা নেন।
২৫শে জুন পাকবাহিনীর সঙ্গে ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধের অল্প কিছুদিন পর আফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতাল নামে একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল গড়ে ওঠে। আফসার বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা এক ব্যাটালিয়নে উন্নীত হওয়ায় এর নামকরণ করা হয় আফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতাল। পরবর্তী সময়ে আফসার বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ ৪ হাজার পাঁচশত জনে উন্নীত হলে তা একটি বিশাল বাহিনীতে পরিণত হয়। ত্রিশালের রায়ের গ্রামের যুদ্ধে ১৫-১৬ জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হলে তাঁদের নিয়ে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। হাসপাতালের ডাক্তার ও সেবকগণ আহত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথমে ডাকাতিয়া ইউনিয়নের ঢালুয়া পাড়ায় কেমত আলী খানের বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং এ বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করে চিকিৎসা চালান। স্থানটি নিরাপদ না হওয়ায় মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদের পরামর্শে ২২শে সেপ্টেম্বর ভালুকার দক্ষিণ সীমান্তবর্তী বাসাইল থানাধীন (বর্তমানে সখীপুর উপজেলা) কালমেঘা গ্রামকে নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নিয়ে আফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতালের কার্যক্রম স্থায়ীভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার, সেবক ও সেবিকাগণ বিভিন্ন যুদ্ধে আহত মুক্তিযােদ্ধাসহ মুক্তিকামী মানুষকে আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যেতে থাকেন। এলাকার মানুষের সহযােগিতায় ডাক্তারগণ সব ধরনের গােপনীয়তা বজায় রেখে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।
ভালুকা, ত্রিশাল, গফরগাঁও, কালিয়াকৈর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্ধার করে কালমেঘা গ্রামে আফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতালে এনে নিবিড় চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হতাে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক্তার, সেবক ও সেবিকাগণ আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তােলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতালে প্রায় ৫-৬শ আহত মুক্তিযােদ্ধা চিকিৎসা নেন।
৮ই ডিসেম্বর ভালুকা হানাদারমুক্ত হওয়ার অল্প কয়েকদিন পর মিত্রবাহিনীর প্রধান সাথ সিং বাবাজী ভালুকা এসেআফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতাল পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি হাসপাতালটির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে রেডক্রসের সঙ্গে যােগাযােগ করে প্রয়ােজনীয় মেডিকেল সরঞ্জামাদি ও ঔষুধপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ৮ই ডিসেম্বরের পর আফসার ব্যাটালিয়ন স্মৃতি হাসপাতাল মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদের পরামর্শক্রমে রােগী, ডাক্তার, সেবক ও সেবিকাগণসহ ভালুকায় স্থানান্তরিত করা হয়। প্রথমে থানা পরিষদ হলরুমে ও পরে ভালুকা বাজারে ৪ মাস হাসপাতালটির কার্যক্রম চলে। ডাক্তার ওয়াইজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৪ জন চিকিৎসক, ১০ জন সহকারী চিকিৎসক ও ৪ জন সেবিকা নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসা কাজ চলতে থাকে। চিকিৎসকরা হলেন- ডা. রমজান আলী তরফদার এমও, ডা. ইউসুফ আলী এমবিবিএস (ফুলবাড়িয়া), ডা. মােহাম্মদ আলী এমও, ডা. আ. রশিদ এমও; সহকারী চিকিৎসকবৃন্দ হলেন- ডা. আ. ছােবান চৌধুরী এলএমএফ, ডা. আনছার উদ্দিন এলএমএফ, ডা. আব্দুল বাছেদ (ন্যাশনাল), ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ ভিডি, ডা. আব্দুল মােতালেব, ভিডি (গফরগাঁও), ডা. পরেশ চন্দ্র সরকার ভি ডি, ডা. শ্রী সনাতন চন্দ্র সরকার ভিডি, ডা. আছমত আলী ভিডি, ডা নূরুল ইসলাম ভিডি এবং সেবিকাবৃন্দ হলেন- মােছা. আনােয়ারা বেগম (সখিপুর), মােছা. সুফিয়া বেগম (ভালুকা), মােছা. আনােয়ারা খাতুন (ভালুকা) ও রঞ্জিতা রাণী (ভালুকা)। পরে এখানে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। [মাে. শফিকুল ইসলাম কাদির]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড