আবদুল গফুর গ্রুপ
আবদুল গফুর গ্রুপ (সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী এর প্রধান ছিলেন আবদুল গফুর (পিতা আহমদ কবির, হাছনদণ্ডি, চন্দনাইশ)। তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর সদস্য।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে আবদুল গফুর মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে আরাে ৭ জনের সঙ্গে সাতকানিয়া উপজেলার ফকিরখীল থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এই ৭ জনের মধ্যে ৬ জন হলেন- রশিদ আহমদ (পিতা হাজি কমল মিয়া, দোহাজারী), স্বপন মজুমদার (জামিজুরী, দোহাজারী), কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী, যীশু, কল্যাণ মহাজন ও তাঁর ছােট ভাই। আবদুল গফুর ও রশিদ আহমদ ছাড়া অন্যরা শরণার্থী হিসেবে যান। তাঁরা মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাছিতলং ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাম্পে পৌছলে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়া প্রখ্যাত ব্রিটিশবিরােধী বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার (পিতা চন্দ্রকুমার দস্তিদার) ও তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র সেখানে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে ৯ই মে পূর্ণেন্দু দস্তিদার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ক্যাম্প থেকে ইন্ডিয়ান সরকারকে এই বিপ্লবীর মৃত্যুর খবর জানানাে হলে সরকারের তরফ থেকে একটি হেলিকপ্টার পাঠানাে হয়। কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় হেলিকপ্টারটি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ফলে পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে ক্যাম্পেই দাহ করা হয়। এরপর আবদুল গফুর
ও রশিদ আহমদরা দেমাগ্রির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দেমাগ্রি পৌছানাের পর আবদুল গফুর ও রশিদ আহমদ থেকে অন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর উভয়ে লুংলাই এসে শীলছড়ি যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর আবদুল গফুর অজিত শীল ও রশিদ আহমদ শিশির মজুমদার ছদ্মনামে শীলচর যাবার চেষ্টা করলে আবদুল গফুরকে গ্রেপ্তার করে লুংলাই জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। রশিদ আহমদ গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। ৭-৮ দিন জেলে থাকার পর আবদুল গফুর মুক্ত হয়ে একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আবদুল গফুর এক পর্যায়ে ১নং সেক্টরের অধীন হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছান। পরবর্তীতে এখান থেকে তাঁর নেতৃত্বে ১১৭ নং গ্রুপ আরাে একটি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১১৭ নং গ্রুপের সদস্যদের ওপর নির্দেশ ছিল, তাঁরা চন্দনাইশ, পটিয়া, সাতকানিয়া, লােহাগাড়া, চকরিয়া, বাঁশখালী প্রভৃতি অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নেবেন। গ্রুপটির সদস্যরা দেমাগ্রি, কাচার ডিস্ট্রিক্ট ভরাহাই ক্যাম্প ও শীলচর লােহারবন ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। তারা ৩৬ কার্বন মেশিনগান, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি, প্রােপাকান্ডা, ৩০৩ রাইফেল, ২ ইঞ্চি মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড, মাইন, বিস্ফোরক, মার্ক-০৪ রাইফেল-সহ অনেক ধরনের অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
১১৭ নং গ্রুপ ও তাঁদের সঙ্গে আসা অপর গ্রুপ বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের অনেক প্রতিবন্ধকতা মােকাবিলা করে। ১১৭ নং গ্রুপ চন্দনাইশ, পটিয়া, সাতকানিয়া, লােহাগাড়া, চকরিয়া, বাঁশখালী প্রভৃতি অঞ্চলে যেসব অপারেশনও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় সেসবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে- পটিয়া ইন্দ্রপােল অপারেশন, আনােয়ারা থানা অপারেশন, কাঞ্চনা যুদ্ধ, দোহাজারী যুদ্ধ প্রভৃতি। প্রায় দুঘণ্টা যাবৎ চলা কাঞ্চনা যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। এ-যুদ্ধে দুজন রাজাকার পালাতে পেরে গফুর গ্রুপের কাছে ধরা পড়ে। তাদের চোখ বেঁধে এওচিয়া ইউনিয়নের আবদুর রহমান শিকদারের বাড়ির উত্তর পাশে বখসি খিলের টেকের দক্ষিণ পাশে নিয়ে যাওয়ার পর কমান্ডার আবদুল গফুর তাদের গুলি করে হত্যা করেন। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দোহাজারী যুদ্ধের পরিচালনায় ছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনী।
১১৭ নং গ্রুপ তাতে অংশ নিয়ে অসম বীরত্বের পরিচয় দেয়। দোহাজারী যুদ্ধ শেষ হয় ১৩ই ডিসেম্বর। সেদিন যুদ্ধশেষে দোহাজারী ব্রিজের দুপাশে দাঁড়িয়ে মিত্রবাহিনী আকাশের দিকে বিজয়ের গুলি ছােড়ে এবং কমান্ডার আবদুল গফুর বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন। ১১৭ নং গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- আবদুল গফুর (পিতা আহমদ কবির, হাছনদণ্ডি, সাতবাড়িয়া, চন্দনাইশ; গ্রুপ কমান্ডার), শ্যামাচরণ নাথ, কলাউজান, লােহাগাড়া, চট্টগ্রাম; ডেপুটি কমান্ডার), ব্রজেন্দ্র লাল দেবনাথ (পিতা রামানন্দ দেবনাথ, কলাউজান, লােহাগাড়া), দিলীপ কুমার চন্দ (সাতকানিয়া), নীলরতন দাশগুপ্ত (চরতি, সাতকানিয়া), ওবাইদুর রহমান (পিতা মনির আহমদ, উত্তর কাঞ্চনা, সাতকানিয়া), দীনবন্ধু দেবনাথ (মুলুক চোবান, আমিরাবাদ, লােহাগাড়া), জামাল (মিরসরাই, চট্টগ্রাম), নিজাম (মিরসরাই, চট্টগ্রাম), জাহেদ আহমদ (মিরসরাই, চট্টগ্রাম), মনমােহন নাথ (কলাউজান, লােহাগাড়া), সুধীর দাশ (নলুয়া, সাতকানিয়া), তেজেন্দ্র নাথ (লােহাগাড়া), অরুণ (সাতকানিয়া), সিদ্দিক আহমদ (চকরিয়া, কক্সবাজার), নুর আহমদ, সিরাজ, নুরুল হক (কাটগড়, কালিয়াইশ, সাতকানিয়া) ও আবদুল হাকিম (কলাউজান, লােহাগাড়া)। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড