আনােয়ারা থানা অপারেশন
আনােয়ারা থানা অপারেশন (আনােয়ারা, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ২৩শে সেপ্টেম্বর। এতে ৩ জন পুলিশ ও ১২ জন রাজাকার- নিহত এবং থানার ওসি এম এ খালেদ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। এ অপারেশনের প্রধান কমান্ডার ছিলেন সার্জেন্ট মহিউল আলম এবং অপারেশন কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার আবু মােহাম্মদ ইসলাম। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৬ জন সৈনিকসহ (নতুন রিক্রুট) পাঞ্জাবি মিলিশিয়া, বিপুল সংখ্যক পুলিশ, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল আনােয়ারা থানা। তাদের অত্যাচারে আনােয়ারাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা প্রতিনিয়ত নিরীহ মানুষদের খুন ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। তাদের অত্যাচার থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষা করার জন্য সার্জেন্ট মহিউল আলম ২৩শে সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে বারখাইন ক্যাম্প থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের বিশাল দল নিয়ে থানা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে রাত ১টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা বােয়ালগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জড়াে হন। সেখান থেকে গ্রামের পথ ধরে আনােয়ারা গ্রামের দক্ষিণ পাশে মুক্তিযােদ্ধা ভূপাল দাশগুপ্ত ও পীযূষ চৌধুরীর বাড়িতে এসে অবস্থান নেন। ভূপাল দাশগুপ্তের মাতা তরু দাশগুপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খাবারের আয়ােজন করেন। মুক্তিযােদ্ধারা রাতের খাবার খেয়ে ভাের হওয়া পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ভাের ৫টায় আনােয়ারা থানা আক্রমণ করেন। রাতের অন্ধকারে সহযােদ্ধারা একে অপরকে চেনার জন্য সংকেত হিসেবে ‘সংগ্রাম’ শব্দটি ব্যবহার করেন। যােদ্ধাদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রথম দলের দায়িত্বে থাকেন কমান্ডার সার্জেন্ট আলম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পটিয়ার আবদুস সবুর ও আনােয়ারার মােহাম্মদ নাসিম। দ্বিতীয় দলের দায়িত্বে থাকেন আবু মােহাম্মদ ইসলাম এবং তৃতীয় দলের দায়িত্ব নেন। আইয়ুব আলী ও এম এ মজিদ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী যােদ্ধাদের দ্বিতীয় দলটি গুলি করতে-করতে থানা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢােকার চেষ্টা করে। অন্য দুগ্রুপের যােদ্ধারা তাদের অবস্থান থেকে উপর্যুপরি গুলি করে শত্রুদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর তারা স্মােক বােমা ছােড়েন। এতে রাজাকাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থানা ছেড়ে পাশের প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা এরপর প্রাইমারি স্কুল দখলে নিয়ে পুলিশ ও রাজাকার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। তাদের মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৬ জনসহ ৫৮ জন পুলিশ ও রাজাকার ছিল। এ অপারেশনে ৩ জন পুলিশ ও ১২ জন রাজাকার নিহত এবং থানার ওসি এম এ খালেদ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা থানায় রক্ষিত থানা সার্কেল অফিসার ডেভেলপমেন্টের ৩ লাখ, পােস্ট অফিসের ১৫ হাজার ও রাজাকারদের বেতনের টাকা উদ্ধার করেন। এছাড়া ৬টি স্টেনগান ও ৬৬টি রাইফেল মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে থাকা আনােয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্র জামাল, বাদল ও স্বপনসহ কয়েকজন উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্র বারখাইন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে বহন করে নিয়ে যায়। কয়েকজন পুলিশসহ থানার ওসি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে সম্মতি জানালে সার্জেন্ট মহিউল আলম তাদের মুক্তি দিয়ে পুনরায় থানায় কর্তব্য পালনের এবং গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন।
আনােয়ারা থানা অপারেশনে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- প্রধান অপারেশন কমান্ডার সার্জেন্ট মহিউল আলম (বরিশাল), অপারেশন কমান্ডার হাবিলদার আবু মােহাম্মদ ইসলাম (পিতা হামিদ হােসেন, কানাইমাদারি, চন্দনাইশ), আবুল বশর (পিতা মাওলানা মাে. ইছহাক, উত্তর হাশিমপুর, চন্দনাইশ), ডেপুটি কমান্ডার আয়ুব আলী (পিতা হামিদ হােসেন, কানাইমাদারি), আবদুল জব্বার (কানাইমাদারি), দুদু মিয়া (কানাইমাদারি), আবু বক্কর (বরকল), নুরুল আবছার (কানাইমাদারি), এফএফ ৩৬ গ্রুপের কমান্ডার কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিছ (হাজীগাঁও), এফএফ ৩৫ গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক (বরুমছড়া), নুরুল ইসলাম আবু (বারখাইন), নুরুল আমীন (বারখাইন), এম এ মজিদ (চন্দনাইশ), মাে. আবুল কাসেম (বরুমচড়া), মােহাম্মদ নাসিম (বটতলী), আব্দুস সবুর (বরমা), নুরুল আলম (বটতলী), মােহাম্মদ সফি (বরুমচড়া), সৈয়দ নুর (বটতলী), তরণী সেন মিত্র (বােয়ালগাঁও), মােহাম্মদ হােসেন বাবু (পীরখাইন), সিরাজুল ইসলাম খান (শােলকাটা), সমর পাল (খাসখামা), আবদুছ ছালাম (উঁইদণ্ডী), ফেরদৌস আহমদ (তেকোটা, সেনাসদস্য), আবদুল আলীম (মামুরখাইন, সেনাসদস্য), আবু ছায়াত (তেকোটা, আনসার সদস্য), মীর আহমদ (তেকোটা), মাে. ইউসুফ (পীরখাইন), বদরুজ্জামান (তেকোটা), আবদুল মান্নান (তেকোটা), আবুল হাশেম মাস্টার (বারখাইন), লােকমান আহমদ শাহ (বারখাইন), মােহাম্মদ আলম (বারখাইন), আহমদ কবির (বারখাইন), ইঞ্জিনিয়ার মাে. শাহজাহান (ডুমুরিয়া), মাে. শাহজাহান চৌধুরী (পীরখাইন), আবু মুসলীম খান প্রমুখ। মুক্তিযােদ্ধারা থানা দখল করে ৩ দিন তাদের দখলে রাখতে সক্ষম হলেও পাকবাহিনী শহর থেকে কামানসহ ৫ ট্রাকভর্তি সেনা ও তাদের দোসর নিয়ে এসে পুনরায় থানার দখল নেয়। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড