আন্দরকিল্লা বন্দুকের দোকান অপারেশন
আন্দরকিল্লা বন্দুকের দোকান অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর) পরিচালিত হয় ১৬ই মার্চ। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার ধারাবাহিকতায় ২রা মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ এবং ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তার জন্য প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ-এর একটি অংশ। আমবাগান পাহাড়ের ওপর কিশাের-তরুণদের নিয়ে অনেকটা সামরিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ শুরু করে। এ প্রশিক্ষণে মার্চপাস্ট করা থেকে রাইফেল চালানাে, নেতার আদেশ-নির্দেশ পালনসহ প্রয়ােজনীয় সবকিছুই শেখানাে হয়। ৭ই মার্চ থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হােস্টেল মাঠে শুরু হয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ।
একদিন আমবাগান এলাকায় বাঙালিদের মিছিল চলছিল। হঠাৎ রেললাইনের পাশের একটি টিনশেড ঘর থেকে একজন বিহারি পাখি শিকারের বন্দুক দিয়ে মিছিলে গুলি করে। এতে কেউ-কেউ আহত হন। তখন উত্তেজিত জনতা আক্রমণ করে বন্দুকটি নিয়ে ভেঙ্গে টুকরাে-টুকরাে করে ফেলে।
এ ঘটনার পর নেতৃবৃন্দ প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই এ ব্যাপারে সাবের আহমদ আসগরী, ডা. মাহফুজুর রহমান, ফাহিম উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ-আল-হারুন, ডা. জাফরউল্লাহ, ডা. মুলকুতুর রহমান এবং মাে. মনসুরুর রহমান বৈঠকে বসেন। চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় (১২০ নম্বর হােল্ডিং) জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের পেছনে এবং ছাত্রলীগ অফিসের কাছে ‘আবদুর রহমান এন্ড কোম্পানি’ নামে একটি অস্ত্রের দোকান ছিল। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় কোনাে এক ছুটির দিনে ঐ দোকানের অস্ত্রগুলাে সংগ্রহ করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ ১৬ই মার্চ অস্ত্র সংগ্রহের অভিযান পরিচালনা করেন। তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন দোকানের সামনের সাটার বন্ধ। নিকটবর্তী বিনােদা ভবন (পরে মনসুর ভবন)-এর সামনে দিয়ে অপারেশন পরিচালনা সম্ভব নয়, কারণ বক্সিরহাট ফাড়িতে রয়েছে অনেক পুলিশ। এমতাবস্থায় অপারেশনে অংশগ্রহণকারীরা নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। তারা মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানাের জন্য আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে নেচে-গেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে শুরু করেন এবং ‘জয় বাংলা, বাংলার জয় গান গাইতে থাকেন। এই সুযােগে অপারেশনে নিয়ােজিতদের কয়েকজন দোকানের পেছনের ভেন্টিলেটর ভাঙ্গার কাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ডা. মাহফুজুর রহমান এবং ফাহিম উদ্দিন ভাঙ্গা ভেন্টিলেটর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অতি সন্তর্পণে তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী একই সঙ্গে বাইরে চলছে গণসঙ্গীত ও স্লোগান, আর ভেতরে চলছে আলমিরা ভেঙ্গে অস্ত্র বের করার কাজ। একজন অস্ত্রের প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন, অন্যজন উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে সেগুলাে বাইরে চালান করছেন। এভাবে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অস্ত্রগুলাে বের করে ছাত্রলীগ অফিসে রাখা হয়। সংগৃহীত অস্ত্রগুলাের মধ্যে ছিল পিস্তল, রিভলবার, বন্দুক ও নানা ধরনের কার্তুজ। নেতৃবৃন্দ এগুলাে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। অস্ত্রগুলাে সংগ্রহ করতে সময় লেগেছিল দুঘণ্টার মতাে।
অস্ত্র সংগ্রহের পর নেতা-কর্মীদের মনােবল বেড়ে যায়। এগুলাে দিয়ে প্রকাশ্যে চলতে থাকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। এছাড়া চট্টগ্রাম কলেজ ও কলেজিয়েট স্কুল থেকে ছাত্রলীগের কর্মীরা কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল সংগ্রহ করেন। মাদারবাড়ি হাবিব ব্যাংকের গােডাউন থেকেও অনেক অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। আন্দরকিল্লা বন্দুকের দোকান থেকে সংগৃহীত অস্ত্রগুলাের কারণে চট্টগ্রামের স্বাধীনতা প্রত্যাশী তরুণরা পেয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের সাহস, ঘাতকদের অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে প্রতিরােধের শক্তি এবং অস্ত্র চালানাের মধ্য দিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলার সামর্থ্য। [সাখাওয়াত হােসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড