You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর উত্তম ও বীর প্রতীক আফতাব আলী

আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক (জন্ম ১৯২৫) বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯২৫ সালের ১লা ডিসেম্বর সিলেট জেলার গােলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ ভাদেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইদ্রিস আলী এবং মাতার নাম জুবেদা খাতুন। তিনি পাঁচ কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম তাহেরা খানম।
আফতাব আলী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সুবেদার পদে সৈয়দপুর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। সৈয়দপুর এলাকা পাকিস্তানপন্থী বিহারি অধ্যুষিত হবার কারণে ২৫শে মার্চের পূর্বেই এখানকার পাকিস্তানি ও বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ২৫শে মার্চ রাতে পাকসেনাদের অপারেশন সার্চলাইট-এর প্রভাব এখানেও পড়ে। সৈয়দপুর সেনানিবাসেও পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি সৈনিকদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। সেখানকার ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির বাঙালি সৈনিকগণ আফতাব আলীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে সেনানিবাস থেকে বের হয়ে গাইবান্ধায় চলে আসেন এবং সেখানকার জেলখানার সকল বন্দিকে মুক্ত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী হয়ে রৌমারীর চরাঞ্চলে অবস্থান নেন এবং সেখানকার ছাত্রযুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি রৌমারী থানা দখল করেন। আফতাব আলী ও তার সহযােদ্ধাদের তৎপরতার ফলে আগস্টের আগ পর্যন্ত গােটা রৌমারী এলাকা মুক্তাঞ্চল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়ে তিনি অদম্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ১৫ই এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে আংরা ব্রিজ যুদ্ধ-এ ২১ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং ১৭টি রাইফেল ও ১টি এলএমজি তাঁদের দখলে আসে। কোদালকাঠিসহ গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে আফতাব আলী অসামান্য অবদান রাখেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম’ ও ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। আফতাব বাহিনী (রাজিবপুর, কুড়িগ্রাম) কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলায় সুবেদার আফতাব আলীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। সিলেট জেলার গােলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাদেশ্বরে ১৯২৫ সালে আফতাব আলীর জন্ম। তাঁর পিতা ইদ্রিস আলী। তিনি ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার ছিলেন। আফতাব আলী ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দূরদর্শী, দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং দায়িত্ববান। উচ্চ কণ্ঠস্বর আর বাঁকানাে গোঁফ তার সামরিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটাত। তার কোম্পানির নাম ছিল ২-MF কোম্পানি, অর্থাৎ ২-মুক্তিফৌজ কোম্পানি। এ কোম্পানিতে সামরিক বাহিনীর সদস্য ছাড়াও কিছু ছাত্র-যুবক ছিল। তাদের সকলের নামের পাশে সামরিক বাহিনীর একটা বড় অংকের নম্বর বসে এবং সকলে ফৌজে পরিণত হন। ফলে যুদ্ধ শেষে অধিকাংশই চাকরিতে থেকে যান।
আফতাব বাহিনীর সদস্যরা ৩০শে মার্চ পর্যন্ত সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করে পাকবাহিনীর ২৫ ২এফএফ রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে এ বাহিনীর ৪০-৪৫ জন সদস্য শহীদ হলে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে আফতাব আলী প্রথমে পলাশবাড়ী-গাইবান্ধা হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে ফুলছড়ি থানার এরান্ডাবাড়ি গ্রামে পৌঁছান। সেখান থেকে ৭০-৭৫ জন লােক নিয়ে পাথরের চর বিওপিতে তিন-চার দিন অবস্থান করে ভারতের আসাম রাজ্যের মানকাচর থানার কামাক্ষ্যা মন্দির সংলগ্ন বিএসএফ ক্যাম্প হয়ে রৌমারীতে পৌছান। রৌমারী এসে কোদালকাটি, রাজিবপুর, টাপুরচর ও যাদুরচরকে প্লাটুন।হেডকোয়ার্টার্স বানিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযােদ্ধাদের ভর্তিসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ছুটিতে আসা সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্য এবং গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া ও জামালপুর থেকে আসা ছাত্র-যুবকদের নিয়ে এ সংখ্যা ৪৫০ জনে উন্নীত হয়। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত রৌমারীর উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড়ের উত্তরদক্ষিণে দীর্ঘ ৮০ কিমি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১০-১৫ কিমি পর্যন্ত এলাকা এ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল। এলাকাটি উত্তরে সাহেবের আলগা ও দক্ষিণে জামালপুর জেলার সবুজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর মধ্যে চিলমারী থানার ২টি ইউনিয়ন অষ্টমীরচর ও নয়ারহাট, উলিপুরের সাহেবের আলগা ও রৌমারীর ৬টি ইউনিয়ন এবং গাইবান্ধার মােল্লাচর, ফুলছড়ি থানার এন্ডারবাড়ি এবং দেওয়ানগঞ্জ থানার ডাংধরা, আমখাওয়া ও পাররাম রামপুর ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ বাহিনী দীর্ঘ ৯ মাস ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব এলাকা মুক্ত রেখে রৌমারীতে ১৮ হাজার মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এক পর্যায়ে আফতাব বাহিনী রাজিবপুর ও এর দক্ষিণাঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেয়। এ সময় রাজিবপুর হাইস্কুলে কোম্পানির হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করা হয়। মুক্ত এলাকার লােকজন আফতাব বাহিনীর উপস্থিতিতে নিজেদের নিরাপদ বিবেচনা করে সকল প্রকার ব্যবসাবাণিজ্যসহ স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যক্রমে অংশ নিত। এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ফসলের ওপর মন প্রতি ৩ টাকা ট্যাক্স ধার্য করে তা আদায়ের মাধ্যমে এ বাহিনীর সৈনিকদের খাবার ও মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। আফতাব বাহিনী কামারজানি পুলিশ ফাড়ি অপারেশন, সুন্দরগঞ্জ থানা অপারেশন, উলিপুর অপারেশন, কালির বাজার পাটগুদাম অপারেশন এবং চিলমারী ও বালাবাড়ী যুদ্ধসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করে। এ বাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় ১লা। অক্টোবর কোদালকাটিতে। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রায় ১৫০ জন সৈন্য নিহত হয়।
আফতাব কোম্পানিতে বেশ কয়েকজন দুঃসাহসী প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন, যাদের মধ্যে রাজিবপুর প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার মনছুর আলী, হাবিলদার জহির, হাবিলদার কুদ্দুস, হাবিলদার মজিদ, হাবিলদার কালাম, হাবিলদার মুহিত, সুবেদার করম আলী (বরিশাল), সুবেদার এনামুল কবির (রৌমারী) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযােদ্ধা মজিদ মুকুল (সাংবাদিক) সুবেদার আফতাব আলীর সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া রৌমারী, রাজিবপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর, পাবনা ও বগুড়ার বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধারা এ বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য আফতাব বাহিনীর প্রধান সুবেদার আফতাব আলী ‘বীর উত্তম’ এবং ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া এ বাহিনীর নিয়মিত সদস্য নুরুল আমিন ‘বীর উত্তম’, হাবিলদার রেজাউল ‘বীর বিক্রম’ এবং তারামন বিবি ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। [মাে.আব্দুস সবুর ফারুকী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!