You dont have javascript enabled! Please enable it!

আফসার বাহিনী

আফসার বাহিনী (ভালুকা, ময়মনসিংহ) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী এর প্রধান ছিলেন আফসার উদ্দিন আহমেদ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সুসংগঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য আফসার বাহিনীর নাম সুবিদিত। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল আফসার উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তাঁরই নামানুসারে এ বাহিনী গঠিত হয়। ১৯২৩ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে জন্মগ্রহণকারী আফসার উদ্দিন আহমেদ তাঁর বর্নিল কর্মজীবনে প্রথমে ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশ আর্মিতে চাকরি করেন এবং সর্বশেষে ইফতেখার ট্রান্সপাের্ট কোম্পানি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। চাকরি জীবন শেষ করে তিনি আওয়ামী লীগ-এর হয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে থাকেন। তাঁর পিতার নাম কেরামত আলী মুন্সি ও মাতার নাম আয়মন নেছা। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত গণহত্যার খবর এবং ২৬শে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্বাধীনতার ঘােষণা শুনে আফসার উদ্দিন আহমেদ প্রতিরােধযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে সামিল হন। চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক জীবনের প্রজ্ঞা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাত্র ৭ জন সহযােদ্ধা সহকারে ত্রিশালের মল্লিকবাড়ি গ্রামে তিনি এ বাহিনী গঠন করেন। আফসার বাহিনী প্রথমে আফসার ব্যাটালিয়ন নামে গঠিত হয়। এ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা হলেন- মাে. আমজাদ হুসেন, আবদুল খালেক মিঞা, নারায়ণ চন্দ্র পাল, আ. বারেক মিঞা, আবদুল মান্নান, অনিল চন্দ্র সাংমা ও মাে. ছমর উদ্দিন মিয়া। আফসার উদ্দিন আহমেদ ও তার ৭ সহযােদ্ধার হাতে ছিল মােট ৮টি রাইফেল। উল্লেখ্য, আফসার বাহিনী গঠনে সহায়তা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাে. আবদুল হামিদ মিঞা, মওলানা জনাব আলী ফকির, ডা. হাফিজ উদ্দিন, মাে. আবদুর রাজ্জাক মিয়া, আবদুল হাফিজ, মাে. মােছলেম মিঞা, প্রেম অধিকারী প্রমুখ। বাহিনী গঠনের শুরুর দিকে তিনি অস্ত্র-সহায়তা হিসেবে মাে. আবদুল হামিদ মিঞার কাছ থেকে একটি রাইফেল ও ৩১ রাউন্ড গুলি পান। পরে চানপুর এলাকায় ইপিআরদের ফেলে যাওয়া ৭টি রাইফেল তাঁর বাহিনী গঠনে সহায়ক হয়েছিল। সাংগঠনিকভাবে দক্ষ আফসার উদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সম্মুখযােদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
তিনি আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে আগরতলায় গিয়ে কর্নেল নুরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। কর্নেল নুরুজ্জামান তাঁকে কিছু অস্ত্র ও প্রদান করেন। মিত্রবাহিনীর ব্রিগ্রেডিয়ার সাথ সিং বাবাজী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর সাহসিকতা, কর্মদক্ষতা ও সাফল্যের জন্য তাঁকে মেজর পদে অধিষ্ঠিত করেন। তাঁকে ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ও ঢাকা সদর উত্তর এলাকার সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আফসার বাহিনীর দক্ষতা ও বীরত্বে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা, ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল, গফরগাঁও ও ঢাকা জেলার কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর, বাশাইল, কালিহাতী প্রভৃতি অঞ্চলের কিছু এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এ মুক্তাঞ্চলে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী বা তাদের দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকারবাহিনী কখনাে সুবিধা করতে পারেনি। তার বাহিনী ৪৫০০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে গঠিত ছিল। সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী তিনি তাঁর বাহিনীকে ৫টি কোম্পানিতে ভাগ করেন। প্রতিটি কোম্পানিতে ছিল ৩টি প্লাটুন ও ৩টি সেকশন আর প্রত্যেক সেকশনে মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন ১৫ জন।
আফসার বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ। বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন জন সহকারী অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ২৪শে এপ্রিল থেকে ২৮শে জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন মােমতাজ উদ্দিন খান। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর ২৯শে জুন থেকে ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন আফসার উদ্দিন আহমেদের ছেলে নাজিম উদ্দিন (পরবর্তী সময়ে শহীদ)। ১৫ই আগস্ট থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবদুল হাকিম দায়িত্ব পালন করেন। ২৮শে সেপ্টেম্বর থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন আবুল কাশেম।
এ বাহিনীকে ৫টি ব্যাটালিয়ন ও ২৫টি কোম্পানিতে ভাগ করার পর যারা কোম্পানি কমান্ডার ও সহকারী কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন: প্রথম ব্যাটালিয়নের ৫ জন কোম্পানি কমান্ডার মাে. চান মিয়া (ঝালপাজা, ভালুকা), মাে. আবদুল কুদুছ খান (বরাইদ, ভালুকা), মাে. আইয়ুব আলী (রায়মণি, ত্রিশাল), মাে. আ. হাকিম (বাটাজোর, ভালুকা) ও মাে. আনছার উদ্দিন মাস্টার (খাগাটী, ত্রিশাল)। এ ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির সহকারী কোম্পানি কমান্ডারগণ হলেন- মাে. কাজিম উদ্দিন, মাে. মজিবুর রহমান (পনাশাইল, ভালুকা), গাজী মাে. আ. বারি মাস্টার (গােপালপুর, ত্রিশাল), মাে. সিদ্দিক হােসাইন, মাে. সিরাজুল হক (রায়মণি, ত্রিশাল)। ২য় ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির কমান্ডারগণ হলেন- শামছ উদ্দিন আহমেদ (বাটাজোর, ভালুকা), মাে. কছিম উদ্দিন (পালগাঁও, ভালুকা), মাে. নাজিম উদ্দিন (নন্দিপাড়া, ভালুকা), মাে. ফয়েজ উদ্দিন (বাটগাঁও, ভালুকা) ও মাে. আবদুল মজিদ (মেদিলা, ভালুকা)। এ ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির সহকারী কমান্ডারগণ হলেন- মাে. মজিবুর রহমান (ডুমনিঘাটা, ভালুকা), মাে. আবদুল হালিম (টাঙ্গাব, গফরগাঁও), মাে. হাসমত আলী (ছলিমপুর, ত্রিশাল), মাে. জবান আলী (তামাইট, ভালুকা), মাে. আবুল কাশেম (তারাকান্দা, ফুলপুর)। ৩য় ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির কমান্ডারগণ হলেন- বশির উদ্দিন আহমেদ (ডাকাতিয়া, ভালুকা), মাে. ফজলুল ওয়াহাব (অলহরী, ত্রিশাল), মাে. ওয়াহেদ আলী (বাটাজোর, ভালুকা), গাজী মাে. নুরুল ইসলাম (কাচিনা, ভালুকা) ও মাে. ফজলুল হক বেগ (বাটাজোর, ভালুকা)। এ ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির সহকারী কমান্ডরগণ হলেন- মাে. তমিজ উদ্দিন, মাে. আইয়ুব আলী, মাে. হাতেম আলী (খুৰ্দ, ভালুকা), মাে. আ. ছাত্তার (দেওয়ানিয়াবাড়ি, ত্রিশাল), মাে. সিরাজুল হক (কাঠালী, ভালুকা)। চতুর্থ ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির কমান্ডারগণ হলেন- মাে. শামসুর রহমান (বাটাজোর, ভালুকা), মাে. সিরাজুল হক (শিলাসী, গফরগাঁও), এমদাদুল হক দুলু (মামুদপুর, ভালুকা), মাে. আ. রাজ্জাক ও মাে. খলিলুর রহমান (ধামশুর, ভালুকা)। এ ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির সহকারী কমান্ডারগণ হলেন- মাে. আ. রশিদ (ধলিয়া, ভালুকা), মাে. খােরশেদ আলম (মেদিলা, ভালুকা), মাে. সিরাজুল হক (কাচিনা, ভালুকা), মাে. আনছার উদ্দিন মুন্সী (গফরগাঁও), মাে. মকবুল হােসেন (ঝুলপাড়া, ভালুকা)। পঞ্চম ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির কমান্ডারগণ হলেন- মাে. আলাউদ্দিন আহমেদ (বাটাজোর, ভালুকা), গিয়াস উদ্দিন আহামদ (পিরুজুলি, কালিয়াকৈর), মাে. আবদুল করিম পাঠান (গুজিয়াম), এম এম শামসুল হক (আংগারপাড়া, ভালুকা) ও আ. ছামাদ (ডাকাতিয়া, ভালুকা)। এ ব্যাটালিয়নের ৫টি কোম্পানির সহকারী কমান্ডারগণ হলেন- মাে. আ. কাশেম (বােকাইনগর, গৌরপুর), মাে. সিরাজুল হক, আ. মান্নান (আমিরাবাড়ি, ত্রিশাল), মাে. নুরুল আমিন খান (সাউথকান্দা, ত্রিশাল) ও মাে. আ. মােতালেব খান (নন্দিপাড়া, ভালুকা)।
আফসার ব্যাটালিয়নের ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ ছিল। উপদেষ্টারা হলেন- মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ (অধিনায়ক), ডা. ওয়াইজ উদ্দিন আহমেদ (মেডিকেল অফিসার), মাে. হাফিজুর রহমান (আর্মি-ইনচার্জ), মাে. আ. হাকিম (কোম্পানি কমান্ডার), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আখতার হােসাইন মণ্ডল (সিকিউরিটি অফিসার), মাে. ফজলুল হক বেগ (কোম্পানি কমান্ডার), মাে. ফজলুল ওয়াহাব (কোম্পানি কমান্ডার), মাে. আনসার উদ্দিন মাস্টার (কোম্পানি কমান্ডার) ও আবদুল জলিল (কোয়ার মাস্টার)।
আফসার বাহিনী অত্র এলাকায় প্রায় শতাধিক সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া অনেকবার এ বাহিনী। শত্রুশিবিরে আক্রমণ করেছে, পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের হটিয়েছে। এ বাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধগুলাে হলােভালুকা উপজেলা: ভালুকা থানা দুবার আক্রমণে ১৬টি রাইফেল, ৩০টি বেয়নেট ও সহস্রাধিক রাউন্ড গুলি মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। ২৩শে জুন মুক্তিযােদ্ধারা পারুলদিয়া নদীপথে আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীর দোসর পুলিশ আটক ও অস্ত্রসহ গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। ২৫শে জুন ভাওয়ালিয়াবাজু প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী এযুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা নিহত এবং মুক্তিযােদ্ধা আ. মান্নান শহীদ হন। ২৯শে জুন ভালুকা থানায় গ্রেনেড হামলায় ১৭ জন হানাদার সৈন্য নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। ১৯শে জুলাই সিডস্টোর বাজার যুদ্ধে ২৩ জন পাকসেনা নিহত ও ৯ জন আহত হয়। অন্যান্য যুদ্ধের মধ্যে ডাকাতিয়া আংগারাগাড়া বাজার যুদ্ধ (৪ঠা আগস্ট), ভয়াবহ ঘাট যুদ্ধ (১৫ই আগস্ট), ভরাডােবা যুদ্ধ (৪ঠা সেপ্টেম্বর), বান্দিয়া যুদ্ধ (১৮ই সেপ্টেম্বর), রাজৈ বাজার যুদ্ধ (১৮ই সেপ্টেম্বর), পনাশাইল বাজার যুদ্ধ (১৯শে সেপ্টেম্বর), বয়রার টেক সম্মুখ যুদ্ধ (২৫শে সেপ্টেম্বর; গ্রেনেড ও গােলাবারুদ উদ্ধার), বরাইদ যুদ্ধ (২১শে সেপ্টেম্বর এবং ১লা অক্টোবর), সাগরদিঘীর পথে বাজুয়া ঝােড়ার খালের পাড় যুদ্ধ (১লা অক্টোবর), তালার যুদ্ধ (৩রা অক্টোবর), বাগেরপাড়া যুদ্ধ (৩রা অক্টোবর), বিরুনীয়া যুদ্ধ (৫ই অক্টোবর), মল্লিকবাড়ি পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ (একাধিকবার, সর্বশেষ ৭ই অক্টোবর এখানে মুক্তিযােদ্ধা অনিল সাংমা শহীদ হন), মেদুয়ারী রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ (১৩ই অক্টোবর), ধলিয়া গ্রাম যুদ্ধ (২৫শে অক্টোবর), পনাশাইল চুল্লার খালপাড় যুদ্ধ (২৭শে অক্টোবর), ভালুকা পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ (২৮শে অক্টোবর; ৯ জন পাকসেনা ও ৬ জন রাজাকার নিহত), রাজৈ গ্রাম সম্মুখ যুদ্ধ (২রা নভেম্বর; একজন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত), ভাণ্ডার যুদ্ধ (১৭ই নভেম্বর; ৪ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ), চান্দের আটি যুদ্ধ (১২ই নভেম্বর; ডা. শমসের আলীসহ ৪ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ), সাতেঙ্গা যুদ্ধ (১৬ই নভেম্বর), মামারিশপুর যুদ্ধ (২০শে নভেম্বর; নিগুয়ারির জহিরুল হক শহীদ), কাঠাল বড় রাস্তায় যুদ্ধ (২রা ডিসেম্বর), ভাওয়ালিয়াবাজু ২য় যুদ্ধ (৩রা ডিসেম্বর), বশিল যুদ্ধ (৪ঠা ডিসেম্বর), ভালুকা সদর পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ (৬ই ডিসেম্বর; ২০ জন পাকসেনা ও বহুসংখ্যক রাজাকার নিহত), ভালুকা পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ ও দখল (৭ই ডিসেম্বর), মধুপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে পলায়নরত পাকসৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ (১৩ই ডিসেম্বর; কোম্পানি কমান্ডার নাজিম উদ্দিন (নন্দিপাড়া) আহত), পাড়াগাঁও জঙ্গল যুদ্ধ (১৪ই ডিসেম্বর; মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদের ৩য় ছেলে নাজিম উদ্দিন আহমেদ ও ডাকাতিয়া আউলিয়া চালার গফুর সরকারের ২য় ছেলে মুন্নেছ আলী শহীদ) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
গফরগাঁও: আফসার বাহিনীর এখানকার যুদ্ধসমূহের মধ্যে দেউল পাড়া টহল ট্রেন আক্রমণ (১৭ই জুলাই), আইতখালা বাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ (৮ই অক্টোবর), দেউলপাড়া রেলওয়ে ব্রিজ আক্রমণ (৯ই অক্টোবর), মশাখালি রেলওয়ের ফরচঙ্গী পুলের পাড় যুদ্ধ (১৫ই অক্টোবর; মাইন বিস্ফোরণে ছােটা বড়াই গ্রামের কিশাের মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল মান্নান শহীদ), শীলা নদী পুল আক্রমণ (১৬ই অক্টোবর), রেলওয়ে ফরচঙ্গী পুলের দক্ষিণে পাঁচগড়িয়ে পুল আক্রমণ (১৬ই অক্টোবর), প্রসাদপুর বাজার যুদ্ধ (১৮ই অক্টোবর; ৪ জন পাকসেনা ও ৪ জন রাজাকার নিহত), ফরচঙ্গী পুলের বাংকার দখল যুদ্ধ (১৯শে অক্টোবর), শীলা নদীর পাড় যুদ্ধ (২২শে অক্টোবর), প্রসাদপুর গ্রাম যুদ্ধ (২৩শে অক্টোবর), রসুলপুর আমলীতলা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল (৩১শে অক্টোবর; মুক্তিযােদ্ধা মােমতাজ উদ্দিন শহীদ), ঢাকাময়মনসিংহ রেল লাইনে মশাখালী যুদ্ধ (৫ই ডিসেম্বর), ভারইল গ্রাম যুদ্ধ (৮ই ডিসেম্বর) এবং গফরগাঁও পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল (৯ই ডিসেম্বর) উল্লেখযােগ্য।
ত্রিশাল: ত্রিশালের রায়ের গ্রামে ১৩ই সেপ্টেম্বর আফসার বাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ৭ ঘণ্টা স্থায়ী এ- যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ১০ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। ২৬শে অক্টোবর কাশিগঞ্জ-আমিরাবাড়িতে অপর একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৬৫ জন রাজাকার নিহত, ৫২টি রাইফেলসহ প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার এবং ১৭ জন রাজাকার আটক হয়। ২৭শে অক্টোবর মেজর আফসার উদ্দিনের ছােটভাই আশ্রাফ উদ্দিনের নিকটপােড়াবাড়ির রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকাররা ১টি এলএমজি, ৭০টি রাইফেল ও অজস্র গােলাবারুদ নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ৩রা নভেম্বর সাকুয়া শেখ বাজার রাজাকার ক্যাম্পের ৮ জন রাজাকার ৮টি রাইফেলসহ কমান্ডার আশ্রাফ উদ্দিনের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এছাড়া ত্রিশালে আফসার বাহিনীর সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর অন্যান্য যুদ্ধের মধ্যে কানিহারী অপারেশন (৩রা আগস্ট), সাকুয়া অপরাশেন (৫ই আগস্ট), মােক্ষপুর অপারেশন (৬ই আগস্ট), ধানীখােলা, কাঁঠাল, কালীবাজার অপারেশন (১৬ই আগস্ট), পােড়াবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ (৫ই অক্টোবর), অলহরীর বানার নদীর পুল ধ্বংস অপারেশন (৫ই অক্টোবর) এবং ত্রিশাল পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল (১০ই ডিসেম্বর) উল্লেখযােগ্য।
কালিয়াকৈর: এখানকার উল্লেখযােগ্য যুদ্ধসমূহ হচ্ছেশালদাহপাড়া অপারেশন (২৮শে আগস্ট), কালিয়াকৈর পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ (৯ই অক্টোবর), কালিয়াকৈর থানায় রাজাকার দলের সঙ্গে যুদ্ধ (১২ই অক্টোবর), কাচিঘাটা গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ (২৮শে অক্টোবর), ফুলবাড়িয়া রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ ও দখল (৩০শে অক্টোবর; ১১ জন রাজাকারের আত্মসমর্পণ) এবং কালিয়াকৈর থানা পাকসেনা ক্যাম্পে ৪ ট্রাক ভর্তি হানাদার সৈন্যর ওপর আক্রমণ (৬ই ডিসেম্বর)।
শ্রীপুর: এখানে আফসার বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধের মধ্যে ছিল বিধাই গ্রামে অপারেশন (৩রা জুলাই; ৩টি রাইফেল উদ্ধার), মাওনা অপারেশন (২৬শে জুলাই), বলদিঘাট অপারেশন (৩১শে জুলাই), ভিটিপাড়া যুদ্ধ, কাপাসিয়া যুদ্ধ ইত্যাদি।
অন্যান্য যুদ্ধ: এছাড়া ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় আফসার বাহিনী পাকবাহিনীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এর মধ্যে টাঙ্গাইল জেলায় বল্লা যুদ্ধ (১২ই মে), ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার আছিম রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ (৬ই অক্টোবর), ময়মনসিংহের নান্দাইল যুদ্ধ (২৩শে নভেম্বর) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
৭১-এ সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা ছাড়াও আফসার বাহিনীর উদ্যোগে কতিপয় জনহিতকর কর্মসূচি গৃহীত ও পরিচালিত হয়। এর মধ্যে একটি হলাে- ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল পরিচালনা। আফসার উদ্দিন আহমেদ তার বাহিনী গড়ে তােলার সময় একটি হাসপাতালের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ২৫শে মে ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধের পর তিনি প্রতিষ্ঠাকরেন আফসার ব্যাটালিয়ান স্মৃতি হাসপাতাল। সময়ােপযােগী এ উদ্যোগে সামিল হন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবী। এছাড়া এপ্রিল মাসে মেজর আফসার উদ্দিনের উদ্যোগে তার বাহিনীর একদল মুক্তিযােদ্ধা ভালুকার ডাকাতিয়া ইউনিয়ন থেকে হাতে লিখে প্রকাশ করেন জাগ্রত বাংলা নামে একটি বুলেটিন। মে-জুন মাসে এর তিনটি সংখ্যা বের হয়। জাগ্রত বাংলার প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নিকট থেকে পাওয়া দুটি সাইক্লোস্টাইল মেশিনের মাধ্যমে জাগ্রত বাংলা-র আরাে ১১টি সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। আফসার উদ্দিন আহমেদ এর প্রধান উপদেষ্টা এবং এস এ কালাম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে আফসার বাহিনীর অনেক মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। তারা হলেন- নাজিম উদ্দিন আহমেদ (ধামশুর, ভালুকা), আ. মান্নান (মল্লিকবাড়ি, ভালুকা), ডা. শমসের আলী (পাড়াগাও, ভালুকা), মােমতাজ উদ্দিন খান (বান্দিয়া, ভালুকা), অনিল সাংমা (মল্লিকবাড়ি, ভালুকা), আ. খালেক (বাটগাঁও, ভালুকা), আ. জব্বার পাশা (ভালুকা), মতিউর রহমান আকন্দ (ধামশুর, ভালুকা), সিরাজুল হক মােল্লা। (কংসেরকুল, ভালুকা), আমজাত আলী মুন্সি (কাঁঠালী, ভালুকা), শামসুদ্দিন (বরাইদ, ভালুকা), মিজানুর রহমান (আসকা, ভালুকা), আসাদুজ্জামান মীর (আসকা, ভালুকা), আহেদ আলী কারী (আসকা, ভালুকা), মফিজ উদ্দিন খান (আসকা, ভালুকা), ছিদ্দিকুর রহমান (মনােহরপুর, ভালুকা), কামরুল আলম (মেদিলা, ভালুকা), আজিম উদ্দিন (মল্লিকবাড়ি, ভালুকা), মােহাম্মদ আলী (ভয়াবহ, ভালুকা), তমুর উদ্দিন (বালিজুড়ি, ভালুকা), আ. ছােবান মল্লিক (উথুরা, ভালুকা), আনােয়ার হােসেন (মল্লিকবাড়ি, ভালুকা), এম এ ছালাম মিয়া (ডাকাতিয়া, ভালুকা), খােরসেদ আলম (ডাকাতিয়া, ভালুকা), এ কুদ্দুস (ডাকাতিয়া, ভালুকা), মুন্নেছ আলী (আউলিয়ার চালা, ভালুকা), জয়নাল আবেদীন (মুক্ষপুর, ত্রিশাল), আলতাব বাজারী (সানকিভাঙ্গা, ত্রিশাল), আলতাব বাজারী (সানকিভাঙ্গা, ত্রিশাল), মােমতাজ (গােপালপুর, ত্রিশাল), আক্কাছ আলী (আমিরাবাড়ি, ত্রিশাল), নাজিম উদ্দিন (রাজেন্দ্রপুর, ত্রিশাল), আব্দুল মান্নান (পিতা আ. রহমান মুখী, গফরগাঁও), জহিরুল হক (নিগুয়ারী, গফরগাঁও), মােখলেছুর রহমান (রায়ের গ্রাম, ত্রিশাল), গিয়াস উদ্দিন, বিএ (ওলকামান্দি, ফুলপুর), আলী নেওয়াজ (চরখরিচাম, ময়মনিসংহ), আ. কাইয়ুম (ফুলপুর), মফিজ উদ্দিন (পকু), গাদুমিয়া (ধামশুর), ডা. আ. ছামাদ (ভাণ্ডার, ভালুকা), ছফির উদ্দিন মুন্সী (ভাণ্ডার, ভালুকা), রেজাউল করিম (ভাণ্ডার, ভালুকা), আব্দুল জব্বার (হুগলা, পূর্বধলা) ও আলী নেওয়াজ (পাগলাকান্দা, পূর্বধলা)।
স্বাধীনতার পর মেজর আফসার উদ্দিন জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৪ সালে তিনি কারাবরণ করেন এবং ৩ বছর পর মুক্ত হন। তিনি ময়মনসিংহ জেলা জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৮ সালে জেলা জাসদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যােগ দেন এবং ভালুকা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি তার বাহিনীর ২৬ জন শহীদ মুক্তিযােদ্ধার স্মরণে ভালুকা পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে নির্মাণ করেন মুক্তিযােদ্ধা স্মৃতিসৌধ এবং ভালুকার ১১টি ইউনিয়নে এ ২৬ জন শহীদ মুক্তিযােদ্ধার নামে ২৬টি সড়কের নামকরণ করেন।
মেজর আফসার উদ্দিন ৫ ছেলে ২ মেয়ের পিতা। তাঁর স্ত্রী বেগম খায়রুন নেছা আফসার। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদের অনুপ্রেরণার উৎস। স্বামীর সঙ্গে খায়রুন নেছা আফসারও বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাছাড়া তাঁর ৩ ছেলে মাে. খলিলুর রহমান (কোম্পানি কমান্ডার), মাে. খুরশেদ আলম (প্লাটুন কমান্ডার) ও নাজিম উদ্দিন আহমেদ (প্লাটুন কমান্ডার; ১৪ই ডিসেম্বর পাড়াগাঁও যুদ্ধে শহীদ) এবং মেয়ে ফাতেমা বেগম সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পিতার কমান্ডে ঔরসজাত ৪ সন্তান ও স্ত্রীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘটনা বিরল। মেজর আফসার উদ্দিনের ৪র্থ ছেলে কাজিম উদ্দিন ধনু ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদে ভালুকা, ময়মনসিংহ-১১ আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আফসার পরিবার আক্ষরিক অর্থেই একটি মুক্তিযােদ্ধা পরিবার। মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৩ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। [নিপা জাহান]
তথ্যসূত্র: মাে. হাফিজুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে আফসার ব্যাটালিয়ন, ময়মনসিংহ ১৯৭৯; অধ্যাপক অজয় রায় ও শামসুজ্জামান খান (সম্পাদিত), বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড (প্রথম পর্ব), আমিনুর রহমান সুলতান, মুক্তিযুদ্ধে আফসার বাহিনী, বাংলা একাডেমী, ২০১২

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!