You dont have javascript enabled! Please enable it!

আদমদীঘি উপজেলা

আদমদীঘি উপজেলা (বগুড়া) ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভারত থেকে উর্দুভাষী বিহারিরা উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ শহর সান্তাহারে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে স্থানীয় বাঙালিদের বিরােধ বাঁধত। পাকিস্তানিরা এসব ব্যাপারে বিহারিদের ইন্ধন যােগাত। ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি পাকিস্তানিদের সহায়তায় বিহারিরা সান্তাহারে কর্মরত রেলওয়ে অফিসার জিয়াউদ্দীনের বাসায় বােমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ইয়ার্ড কলােনিতে কামরুল বিহারির বাসা থেকে একটি ওয়ারলেস সেট এবং লােকো কলােনি থেকে বেশকিছু তাজা বােমা উদ্ধার করা হয়। পাকিস্তানিরা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় তৈরী এসব গােলাবারুদ বিহারিদের সরবরাহ করত। এ বিষয়টি জানার পর বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, বিহারিরা পাকিস্তানিদের সহায়তায় বাঙালি নিধনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শােনার পর বাঙালিরা বিহারিদের প্রতিরােধ করার প্রস্তুতি নেয়। আওয়ামী লীগ-এর এমপিএ কসিম উদ্দিন আহমেদ, ছাত্রলীগ-এর সভাপতি আজিজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক গােলাম মােরশেদ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম মনজুর নেতৃত্বে একটি প্রতিরােধ কমিটিও গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি তােফায়েল আহমেদ এ সময় সান্তাহারে এলে ইয়াহিয়ার সামরিক আইন ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতার এক বিশাল সমাবেশ ঘটে ও পরে মিছিল বের হয়। কেঁপে ওঠে অবাঙালিদের দুর্গ সান্তাহার।
এদিকে সান্তাহার রেলওয়ে জিআরপি থানার বিহারি হাবিলদার হারুনের নেতৃত্বে বিহারি পুলিশ থানার অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে সান্তাহার শহর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলােতে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ছাতনী গ্রামের জালাল হােসেন, ঢেকড়া গ্রামের মাহতাব উদ্দীন ও কেল্লাপাড়া গ্রামের আখের আলী নিহত হন। বিহারিরা ইয়ার্ড কলােনিতে দেওয়ান আব্দুল মজিদ এবং যােগীপুকুর এলাকায় ডা. কিসমতের স্ত্রী ও শাশুড়িকে আগুনে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরূপ পরিস্থিতিতে গােলাম মােরশেদ যােগাযােগ করেন নওগাঁর রাণীনগর থানার ইউপি চেয়ারম্যান ফিরােজ হােসেন এবং আনসার কমান্ডার মীর হােসেন মাস্টারের সঙ্গে। পরে তারা রাণীনগরের খলিল এবং সিম্বা গ্রামের। ডালিমের নেতৃত্বে রাণীনগর থানার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ৪৩টি অস্ত্র সংগ্রহ করে বিহারিদের প্রতিরােধ করেন। এতে বহু সংখ্যক বিহারি-অবাঙালি নিহত হয়। এ ঘটনার পর থেকেই আদমদীঘির জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শােনার পর থেকেই মূলত এলাকার সচেতন জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে। সাবেক সেনাসদস্য আব্দুস সামাদ সান্তাহার শহরের ডাকবাংলাে মাঠে বেশকিছু যুবককে লাঠি ও বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দান শুরু করেন। একই সময়ে ডুমরি গ্রামের আনসার সদস্য মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে নশরৎপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এবং শিয়ারী গ্রামের আফছার আলী ও শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে আই পি জে স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ চলে। এরপর উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা ভারতে যান। সেখানে কামারপাড়া ক্যাম্পে গােলাম মােরশেদ পলিটিক্যাল মটিভেটরের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি আদমদীঘিতে ফিরে এসে গণবাহিনীর কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব নেন। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গােপনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরি করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। কসিম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ, আজিজুল ইসলাম, গােলাম মােরশেদ প্রমুখ এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এল কে আবুল হােসেন, মনসুর রহমান, আজমল হােসেন, ফজলুল হক, মেজর হাকিম এবং সেনাসদস্য আব্দুস সামাদ।
এ উপজেলায় পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশকালে তেমন কোনাে প্রতিরােধ রচনা করা সম্ভব হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ৮ই মার্চ থেকে এলাকার জনগণ বগুড়া-সান্তাহার কাঁচা সড়কের দুপাশের গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন জায়গায় রেল লাইন উপড়ে ফেলে। কিন্তু সেসব বাধা অতিক্রম করে পাকবাহিনী।
১৯শে এপ্রিল রাণীনগর রেলস্টেশন হয়ে সান্তাহার জংশনে। প্রবেশ করে এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের যান্ত্রিক কারখানা ও আদমদীঘি থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর সহযােগী হিসেবে উপজেলার কালাইকুড়ির আব্দুল মজিদ তালুকদারের নাম উল্লেখযােগ্য। সে দীর্ঘদিন উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগ-এর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার নেতৃত্বে উপজেলায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং তার উপস্থিতিতেই নভেম্বর মাসে আদমদীঘি খাড়ির ব্রিজের পাশের শ্মশান ঘাটে পাকবাহিনী ৪ জন মুক্তিযােদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা খড়ির ব্রিজ শ্মশানঘাট হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। আগস্ট মাসে সুদিন ব্রিজে মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে ৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়, যা সুদিন ব্রিজ গণহত্যা নামে পরিচিত। এছাড়া আব্দুল মজিদ তার সহযােগী সান্তাহার শহরের মােজাম্মেল হক ও ডা. আব্দুল মালেক বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে ছাতিয়ান গ্রামে কয়েকজন বাঙালিকে হত্যা করে। আব্দুল মজিদ তালুকদার ও তার অনুগত রাজাকার বাহিনী যুদ্ধকালীন সময়ে উপজেলার ছাতিয়ান গ্রাম ও শালগ্রামে অগ্নিসংযােগ ও গণহত্যা চালায়। তারা ছাতিয়ান গ্রামের হেমন্ত বসাক, রূপভান, সমিনা বিবি, সুমল বসাক ও চান মােহাম্মদকে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে সমগ্র উপজেলায় কয়েকশ মানুষ শহীদ হয়। তাদের মধ্যে ১৩৪ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আদমদীঘি থানা ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতাে।
এ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের উল্লেখযােগ্য কোনাে যুদ্ধ হয়নি। তবে বিজয়ের কয়েকদিন আগে কমান্ডার ফললুল হক, এল কে আবুল হােসেন, আজিজার রহমান, মাে. নান্টু, নজরুল ইসলাম, আমজাদ হােসেন (সেনাসদস্য), আব্দুল হাকিম প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধা বিভিন্ন স্থানে খণ্ডযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের গেরিলা হামলায় পাকসেনা ও রাজাকাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা থানা আক্রমণ করে বেশকিছু গােলাবারুদ দখল করেন।
১২ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আদমদীঘি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলে এদিন উপজেলা সদর হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন। তবে সান্তাহার শহর তখনাে হানাদারদের দখলে থেকে যায়। ১৪ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে তারা নওগাঁ শহরে পালিয়ে গেলে সান্তাহার হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- আলতাফ হােসেন (চকসােনা), আব্দুল জলিল (পিতা ফজের আলী আকন্দ, কোমারপুর), মনসরুল হক টুলু (কাঞ্চনপুর), আব্দুস সাত্তার (কাঞ্চনপুর), আজিজার রহমান (পিতা উমির উদ্দীন শাহ, মালশন), আব্দুল জলিল জোয়ারদার (পিতা মনসের জোয়ারদার, সান্দিড়া), আশরাফ আলী (পিতা মাে. তয়েজ উদ্দীন, পোঁওতা), এস এম আসলাম (পিতা আবুবক্কর সিদ্দীক, ঢেকড়া), মাে. রহিমুদ্দীন (পিতা দশরত প্রামাণিক, দত্তবাড়িয়া), আব্দুল লতিফ (পিতা জাহের আলী, পুসিন্দা), আজিজার রহমান (পিতা আলহাজ্ব বয়েজ উদ্দীন, চাটখইর), আক্কাস আলী (পিতা আলহাজ্ব আশকর আলী, সাকোয়া), জালাল উদ্দীন (পিতা আলহাজ্ব কামাল উদ্দীন, লক্ষিপুর), ইব্রাহিম আলী (পিতা জহির আকন্দ, মটপুকুরিয়া), নজরুল ইসলাম (পিতা কছির ফকির, অন্তাহার), আশরাফ উদ্দীন (পিতা লালচান, অন্তাহার), আব্দুল মজিদ (পিতা ছবেদ আলী, অন্তাহার), আব্দুস সাত্তার প্রামাণিক (পিতা নীলাদ প্রামাণিক, ডহরপুর), মােজাম্মেল হক (পিতা ইশারত প্রামাণিক, কাশিমালা), আমজাদ হােসেন (পিতা আরজ আলী, জোড়পুকুরিয়া), শরিফ উদ্দীন (পিতা ছমির উদ্দীন, শিবপুর), আলতাফ হােসেন (পিতা শমসের আলী মণ্ডল, চকসােনার), মনসুরুল হক টুলু (পিতা তবিবর রহমান, কাঞ্চনপুর), আব্দুস সাত্তার (পিতা মােস্তাকিন, কাঞ্চনপুর) এবং পুলক কুমার বিশ্বাস (পিতা জয়সকিন্দ বিশ্বাস, তালশন)। এছাড়া ময়মনসিংহের মধুপুর গ্রামের সুজিত চন্দ্র নামে একজন মুক্তিযােদ্ধাও এখানে শহীদ হন।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ হলাে- শহীদ সুজিত গেট (পূর্ব সান্তাহার, ঢাকারােড সংলগ্ন), স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ (সান্তাহার রেলগেট চত্বর), আব্দুল মজিদ সড়ক (ছাতিয়ান গ্রাম), শহীদ আজিজার সড়ক, আসলামুদৌলা সড়ক (সান্তাহারঘােড়াঘাট), আইনুল-ময়নুল সড়ক (সান্তাহার হার্ভে স্কুল রােড), পুলক বিশ্বাস সড়ক (হাসপাতাল সড়ক), আব্দুল লতিফ সড়ক (শাওইল), শাহাজাহান সড়ক (খাড়িয়াকান্দি) ও জালাল হােসেন সড়ক (মুরুইল)। [মাে. খায়রুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!