You dont have javascript enabled! Please enable it!

আদারভিটা-নগর গ্রাম গণহত্যা ও গণকবর

আদারভিটা-নগর গ্রাম গণহত্যা ও গণকবর (মাদারগঞ্জ, জামালপুর) জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। পাকিস্তান আমলে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া থানাগুলাের মধ্যে একটি ছিল মাদারগঞ্জ থানা। বিশেষ করে যােগাযােগ ব্যবস্থার দিক থেকে এটি ছিল পশ্চাৎপদ। তারপরও এখানে হানাদার বাহিনীর একাধিকবার আক্রমণ ঘটে এবং বহু মানুষকে হত্যা করে। এদের অনেকের গণকরবে স্থান হয়। যােগাযােগের ক্ষেত্রে খরা মৌসুমে পায়ে হাঁটা ছাড়া মানুষের। অন্য কোনাে বিকল্প পথ ছিল না। বর্ষা মৌসুমে দূরে যাতায়াতের জন্য নৌকাই ছিল যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম। এই নৌপথ দিয়েই মাদারগঞ্জে এসেছিল হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা। দিনটি ছিল ৩রা রমজান শুক্রবার ২৯শে অক্টোবর (বাংলা ১৩৭৮ সনের ১৪ই কার্তিক)। অনেকেই সেহরি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। পাড়ার মসজিদগুলাের কোনাে-কোনােটি থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় পূর্বের হরিপুর গ্রাম থেকে রাজাকারদের সহায়তায় লঞ্চভর্তি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নদীপথ ধরে এসে চরভাটিয়ান গ্রামের আব্দুল মালেক মেম্বারের বাড়ির ঘাটে নামে। সেখান থেকে গােলা-বারুদের বাক্স নিজেরা এবং স্থানীয় কতিপয় লােকের মাথায় তুলে দিয়ে তারা অগ্রসর পশ্চিম দিকে হয়। নগর-নলকা খালে উপস্থিত হয় হানাদার বাহিনী। নলকা গ্রামের মনি শেখের ছােটভাই কাজী শেখ ঘন কুয়াশার মাঝে হানাদারদের বুটের আওয়াজ শুনতে এবং সৈনিকদেরকে আবছা আবছা দেখতে পায়। সে আর বিলম্ব না করে দ্রুত এই খবর পৌছে দেয় ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহার বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে। মুক্তিযােদ্ধারা এ খবর অবগত হন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ একজন অসর্তকভাবে ফাঁকা গুলি করেন। শুরু হয় হানাদার বাহিনীর অবিরাম গুলিবর্ষণ।
তখন আদারভিটা বাজারটি ছিল না। বর্তমান আদারভিটা বাজারটি পূর্ব-পশ্চিম বাবর রাস্তার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত একটি বড় খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পাকিস্তানিদের দেখে এই খালে আত্মগােপন করেন মাে. আব্দুস সােবহান ও তার আপন চাচাতাে সহােদর তিন ভাই মেছের, ঘুতা ও ভােলা। বিষ্ণু মণ্ডলের বাড়ির দক্ষিণ পাশের একটি গর্তে লুকিয়ে থাকেন মাে. আব্দুল গনি, মাে. নূর হােসেন, মাে. আব্দুস সােবহান (পিতা বছির শেখ) ও মাে. আব্দুল কদ্ছ (পিতা মহির উদ্দিন শেখ)। হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মুহূর্তের মধ্যে খাল ও গর্তের কাছে এসে হাজির হয়। আত্মগােপনকারীদের দেখামাত্র হানাদার বাহিনী তাদের গুলি করে। আব্দুল গনির বুকে গুলি লাগে। তিনি গর্তের মধ্যেই নিহত হন। নূর হােসেনের কপালে গুলি লাগে। রক্তক্ষরণে তিনি সেই গর্তেই নিহত হন। এদের হত্যার পর ঘাতক দলটি গুলি করতে করতে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। গর্তে লুকানাে মাে. আব্দুস সােবহান ও মাে. আব্দুল কদ্দুছকে হানাদাররা গর্ত থেকে টেনে তুলে রাস্তার ওপর আনে এবং লাইন করে দাঁড় করায়। তারপর দুই ফুট দূর থেকে রাইফেল তাক করে তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। সঙ্গে-সঙ্গে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আব্দুল কদ্দুছের বুকের বাম পাশ ভেদ করে গুলি পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। যন্ত্রণাকাতর আব্দুল কদ্ছ পানি চেয়েছিলেন। তার চাচি মাে. আব্দুস সােবহানের মা পানি এনে দিয়েছিলেন, কিন্ত সে পানি বেরিয়ে যায় বুলেটে বিদীর্ণ বক্ষ ও পাঁজর দিয়ে। চিৎকার করে আব্দুল কদ্ছ নিথর হয়ে যান। আব্দুস সােবহানের ডান হাতের কনুইয়ের নিচে গুলি লাগে। এ অবস্থায় আব্দুস সােবহান সেখান থেকে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে পালিয়ে গিয়ে হেমরাবাড়ি গ্রামে উপস্থিত হন। সেখানে তুরাপ ডাক্তারের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরে মাদারগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। নিহতদের লাশ দাফন করা হয় নগর-কালীবাড়ি মােড়ের রাস্তার পাশে। পরবর্তীতে রাস্তাটি পাকা করার সময় কবরগুলাে রাস্তার নিচে পড়ে যায়।
আব্দুল গনি, আব্দুল কদ্দুছ ও নূর হােসেনের কবরস্থান। এই পাকা রাস্তার বাঁকের সামান্য দক্ষিণে পিচ ও পাথরের নিচে তাদের কবর।
দুধিয়াগাছা রােডের বালির মােড়ের পূর্বপাশে খালে লুকিয়ে ছিল ঘুতা (পিতা জহির শেখ)। মাে. আজিজুর রহমান ভােলা (পিতা রিয়াজ উদ্দিন সরকার) ও ঘুতাকে এক সঙ্গে বেঁধে হানাদাররা তাদের গুলি করে। ঘুতার বক্ষ ভেদ করা গুলি তার পেছনের পাঁজর বিদীর্ণ করে বেরিয়ে যায়। ঘুতার সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ভােলাকে তারা তিনবার গুলি করে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি বেঁচে যান। এক পাশে গুলি লেগে ভােলা সামান্য আহত হন। কিন্তু মারাত্মক কিছু হয়নি। ঘুতার রক্তে ভিজে ছিল তার শরীর। সে যাত্রায় ভােলা প্রাণে রক্ষা পেলেও বিভীষিকাময় জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি অল্প কিছু দিন বেঁচে ছিলেন। বর্তমান কমিউনিটি ক্লিনিকের উত্তর পাশে তার কবর অবস্থিত।
সেদিন নিহতদের জানাযায় ইমামতি করেছিলেন নগর গ্রামের নুরুল ইসলাম মুন্সি। ঘুতার পৈতৃক নিবাস ছিল পাশের মেলান্দহ উপজেলার ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে। অভাবী এই মানুষটি অপরের বাড়িতে বসবাস করতেন। নগর গ্রামে ফকির শেখ নামে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে তার দাফন হয়। বর্তমানে জনৈক হায়দার মিয়ার মালিকানাধীন বাড়ির ভিটায় কাঁঠাল গাছের ছায়ায় অরক্ষিত কবরে শুয়ে আছেন ঘুতা। ঘুতার ছেলে মান্নান মাঝে-মাঝে বাবার কবরে এসে মােম আর আগর বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
আদারভিটা কালীবাড়ি রােডের পাশে গুলি করে হত্যা করা হয় মেছের মণ্ডলকে। হানাদার বাহিনীর গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে হারিয়ে যায় তার আদরের ছােট্ট মেয়ে। মেয়েকে খুঁজতে বেরিয়েছিল মেছের মণ্ডল। পথে সাক্ষাৎ ঘটে হানাদার সেনাদের সঙ্গে। মেছেরকে হানাদাররা প্রশ্ন করেছিল, মুক্তি কাহা? সহজ-সরল মানুষটি জানায় তার মেয়ে হারানাের কথা। আর সঙ্গে-সঙ্গে গর্জে ওঠে হানাদারের রাইফেল মেছেরের বক্ষ ভেদ করে যায় গুলি। আহত মেছেরকে তারা লাথি মেরে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের খালে। যন্ত্রণায় কাতর মেছের এক সময় নিথর হয়ে যায়। স্বজনরা লাশ তুলে এনে দাফন করে তার নিজ ভিটার দক্ষিণপূর্ব কোনায়। তখন তার স্ত্রী ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বাধীন দেশে ভূমিষ্ঠ হয় মেছেরের পুত্র মজিদ।
নগর গ্রামের ৭ জন ও নলকা গ্রামের ২ জনসহ মােট ৯ জনকে হতাহত করার পর রাজাকার ও হানাদার বাহিনী এগিয়ে যায় পশ্চিম দিকে। আক্রমণের তীব্রতা এবং নিজেদের সামরিক সরঞ্জাম ও শক্তির অপ্রতুলতা বিবেচনা করে সম্মুখ সমরে মােকাবেলা করা সমীচীন মনে করেননি মুক্তিযােদ্ধারা। এলাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় প্রতিরােধ না করে মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ধানে মরিয়া হয়ে হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় নগর গ্রামের খলিল মণ্ডল, জব্বার মণ্ডল, কবীর মণ্ডল, কছিম মণ্ডল, আলতাফ মণ্ডল, তজ মণ্ডল, সিরাজ মণ্ডল, আব্দুছ ছাত্তার বাবু, আব্দুল হাই সরকার, ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা ও তার ভাইদের বাড়িঘর। ভস্মীভূত হয় পরিবারগুলাের সর্বস্ব। হানাদাররা নগর গ্রামের নারীদের পাশবিক নির্যাতন করে।
এলাকার মানুষ সেদিন প্রত্যক্ষ করেছে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ভিন্ন মাত্রা। কবরের মতাে গর্ত করে জীবন্ত মানুষদের তার মধ্যে আবক্ষ পুতে দিয়ে হানাদারের দল তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। তাদের নির্দয় প্রহারের পর ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে কিছু মানুষ প্রাণে বেঁচে যায়। এমন কয়েকজন হচ্ছেন- হেমরাবাড়ি গ্রামের আবুল কাশেম ডিলার, আদারভিটা গ্রামের রবিউল, আলতাফ সুতার, মজিবর, মকবুল, নজরুল মােল্লা, নূর কাশেম, আব্দুল মান্নানসহ আরাে কয়েকজন। নির্যাতনের পর তাদের মাথায় গুলির বাক্স তােলা হয়। গুলির বাক্স তারা ভাটারা রেলস্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আদারভিটা ও নগর এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে হানাদার বাহিনী বেলা ৩টার দিকে তাদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। [রফিকুল ইসলাম ইরফান]।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!