You dont have javascript enabled! Please enable it!

আদিত্যপুর গণহত্যা

আদিত্যপুর গণহত্যা (বালাগঞ্জ, সিলেট) সংঘটিত হয় ১৯শে মে। এ গণহত্যায় ৬৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ১৯শে মে ভােরবেলা চারটি সাঁজোয়া গাড়িতে করে এসে পাকসেনারা আদিত্যপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে এ দেশীয় দালালদের সহায়তায় সমস্ত গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং ঘােষণা করে যে, শান্তি কমিটি গঠন ও প্রত্যেক গ্রামবাসীকে পরিচয়পত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা এখানে এসেছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের মন থেকে সন্দেহ দূর হয় না। তারা বুঝে উঠতে পারছিল না, শান্তি কমিটি গঠন আর পরিচয়পত্র দেয়ার জন্য এত ভােরে তাদের আসতে হবে কেন। অবশেষে সবাইকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে জড়াে হতে বলা হয়। অস্ত্রের মুখে তাদের সেখানে নিয়ে যেতে-না-যেতেই সবকিছু দিনের মতাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘটনাস্থলে আগে থেকেই অবস্থানরত একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা আবদুল আহাদ চৌধুরী সাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর আলােচনা হয়। আহাদ চৌধুরী পরামর্শ দিতেই জনৈক ক্যাপ্টেনের নির্দেশে পাকসেনাদের রাইফেলগুলাে গর্জে ওঠে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে ৬৩টি তাজা প্রাণ। নিরাপদ মনে করে যারা প্রাণভয়ে আগে থেকেই আদিত্যপুর গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের অনেককেই এ হত্যাকাণ্ডে জীবন দিতে হয়। এদিনের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে শহীদদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায়, তারা হলেন- আদিত্যপুরের রাধিকারঞ্জন সেন (শিক্ষক), শ্ৰীশ সেন (নায়েব), শৈলেন চন্দ্র দেব, দীনেশ চন্দ্র দেব, ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেব, সুরেশ চন্দ্র দেব, মতিলাল দেব, সুধীর চন্দ্র দাশ, বিপুল চন্দ্র দেব, সুখেন্দ্র সেন (ছাত্র), দক্ষিণা দেব, অতুল আচার্য, নরেশ দাশ, হৃদয় শুক্লবৈদ্য, কৃষ্ণ শীল, দিগেন্দ্র চন্দ্র শীল, যতীন্দ্র দাশ, রাকেশ শব্দকর, সুরেশ শুক্লবৈদ্য, সুধন দাশ, সত্যপুরের ধনাই রাম নমশূদ্র, বিহারী নমশূদ্র, বসন্ত নমশূদ্র, প্রভাত নমশূদ্র, বলাই নমশূদ্র, মহেন্দ্র নমশূদ্র, ঈশান নমশূদ্র, বলই নমশূদ্র, নারায়ণ নমশূদ্র, লক্ষ্মীপুরের সতীশ চন্দ্র দাশ, দাশপাড়ার দীনেশ দেব, ইলাশপুরের নরেশ ধর, দিগেন দেব, মশাখলার দিনেশ, চান্দপুরের যতীন্দ্র দত্ত পুরকায়স্থ (চরকী বাবু), তাজপুরের খােকন, পশ্চিম সিরাজনগরের অমর দেব, ননী দেব এবং বুরুঙ্গার কলিন শব্দকর ও পরেশ শব্দকর। সেদিন গুলির আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হওয়ার পরও বেঁচে যান সুশান্ত গুপ্ত পুরকায়স্থ (মিলন) ও বুলু দে।
সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। পর মুহূর্তেই তারা ঝাপিয়ে পড়ে গ্রামের যুবতি নারীদের ওপর এবং নির্বিচারে পাশবিক নির্যাতন চালায়। অনেককে নিজেদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা এখানে এসে মাটি খুঁড়ে নিহতদের লাশ উঠিয়ে সিলেটে নিয়ে যান। দেশী-বিদেশী বহু সাংবাদিকের উপস্থিতিতে লাশের সংখ্যা নিরূপণ ও লাশ শনাক্ত করে সেগুলাে আবার নিয়ে আসা হয়। আদিত্যপুরে এবং পূর্ববর্তী স্থানেই কবর দেয়া হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে স্থানীয় জনৈক তাজুল মােহাম্মদের প্রচেষ্টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লতিফুর রহমানের উদ্যোগে গণকবরটির সীমানা দেয়াল তৈরি করা হয়।
৭১-এর ২২শে মে বালাগঞ্জ থানার ওমরপুর বাজার থেকে তােতা মিয়া, ওজীব উল্লা চেগুল, শফিকুর রহমান ও মদরিছ আলীকে ধরে নিয়ে হত্যা করার দায়ে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে পাকবাহিনীর দালাল আবদুল আহাদ চৌধুরী ছাদ, আলিম উদ্দিন, মৌলবী মােদরিস আলী ও জানু মিয়া ওরফে আজিজুল হকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। [জগন্নাথ বড়য়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!