আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন ঠাকুরতলা গণহত্যা
আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন ঠাকুরতলা গণহত্যা (মহেশখালী, কক্সবাজার) সংঘটিত হয় ৬ই ও ৭ই মে। এ গণহত্যায় ৫ শতাধিক মানুষ শহীদ হন।
মহেশখালী উপজেলার ঠাকুরতলায় আদিনাথ মন্দিরকে কেন্দ্র। করে মৈনাক পাহাড়ের চারিপাশে গড়ে উঠেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের জনবসতি। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে পাহাড়ি নির্জন মন্দির এলাকা ভেবে পার্শ্ববর্তী চকরিয়া, বাঁশখালী, আনােয়ারা, সাতকানিয়া, পটিয়া প্রভৃতি এলাকার শতশত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লােকজন ঠাকুরতলার আদিনাথ মন্দির এবং পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় গ্রহণ করে। স্থানীয় দোসর হানাদার বাহিনীকে খবর দেয় যে, আদিনাথ মন্দির মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্গ। ৬ই ও ৭ই মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা মৈনাক পাহাড়, মৈনাক পাহাড়ের পাদদেশ ও আদিনাথ মন্দিরের পাশে ঠাকুরতলায় গণহত্যা চালায়। এসময় তারা মন্দিরের পাশে ব্রাশ ফায়ার করে এক সঙ্গে ১৯ জন মানুষকে হত্যা করে।
আক্রমণকালে হিন্দুদের পবিত্র ধর্মীয় স্থান আদিনাথ মন্দিরকে মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্গ মনে করে মেশিন গানের গুলি দিয়ে ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। বিহার ও মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণকারী ২১ জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। মন্দির সংলগ্ন পাহাড়ে যারা লুকিয়ে ছিল, তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সুধীর চন্দ্র দে (৫৫), গুণরাম দে (৬০), নারায়ণ চন্দ্র দে (৫৮), যতীশ চন্দ্র দে (৪৭), প্রিয়তােষ দে, কমল কৃষ্ণ ঘােষ প্রমুখ। জীবন-মৃত্যুর এক চরম সংকটের সময় মন্দিরের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের পাদদেশে এবং পাহাড়ের ভাজে-ভাজে পানের বরজে আশ্রয় নিয়েছিল শতশত হিন্দু পরিবার। পানের বরজে আশ্রয় নেয়া এসব লােকজনকে হানাদররা ব্রাশ ফায়ার করে। এতে অসংখ্য মানুষ হত্যার শিকার হন। এ গণহত্যায় ৫ শতাধিক মানুষ শহীদ হন। দূর-দূরান্তের হওয়ায় হত্যার শিকার সকল শহীদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে ৪৩ জন শহীদের নাম জানা গেছে। তারা হলেনঠাকুরতলার সুরেন্দ্র লাল দে (পিতা মহিমা চরণ দে), গুণধর চন্দ্র দে (পিতা রমেশ চন্দ্র দে), মনি কুমার দে (পিতা লােথরাম দে), হরিশ চন্দ্র দে (পিতা রতন চন্দ্র দে), রসিক চন্দ্র দে (পিতা হরিশ চন্দ্র দে), যতীশ চন্দ্র দে (পিতা বসন্ত কুমার দে), পরাণ হরি দে (পিতা যতীশ চন্দ্র দে), মিনধন চন্দ্র দে (পিতা যতীশ চন্দ্র দে), অনিল চন্দ্র দে (পিতা বনমালি দে), জয়ন্ত কুমার ঘােষ (পিতা নীলাম্বর ঘােষ), সুধীর চন্দ্র দে (পিতা অন্ন চন্দ্র দে), মন্টু কুমার ঘােষ (পিতা মােহন বাঁশি ঘােষ), যতীশ কুমার দে (পিতা বসন্ত কুমার দে), ধীরেন্দ্র লাল দে (পিতা মেঘবর্ণ দে), চণ্ডী চরণ দে, কাজল দে, সুনীল দে, সুরেন্দ্র লাল দে সুমন্ত (পিতা রজনী। লাল দে), গােরকঘাটা মহেশখালী চরপাড়ার জতরাম দে (পিতা পিয়ারী মােহন দে), গােরকঘাটা দক্ষিণ হিন্দুপাড়ার মণীন্দ্র লাল দে (পিতা লক্ষ্মণ চন্দ্র দে), ছােট মহেশখালী ঠাকুরতলার বাবুল হরি দে (পিতা বংশী রাম দে), সুরেন্দ্র চন্দ্র দে (পিতা মুরালী মােহন দে), অজিত কুমার দত্ত (পিতা ত্রিপুরা দত্ত), সতীন্দ্র দে (পিতা বিনােদ দে), হরেকৃষ্ণ দত্ত (পিতা গােল মােহন দত্ত), ভুথা নাথ দে (পিতা নিমাই দে), সতীন্দ্র দে (পিতা শ্ৰীমন্ত দে), ভেক্কা রাম দে (পিতা শ্ৰীমন্ত দে), সনজিত দে (পিতা ভেক্কা রাম দে), নিরঞ্জন দে (পিতা শ্ৰীমন্ত দে), উ তেজিন্দা মহাথেরাে (পিতা উচাথ্যেই), ক্য চ্য মং (পিতা লু মং), মং চিং য়েন (পিতা ছ লা), আস্মেরি (পিতা থােয়ানছি), পশ্চিম ঠাকুরতলা রাজবংশী মহাজন পাড়ার নিকুঞ্জ দে (পিতা প্রসন্ন দে), আলী আহমদ (পিতা না মিয়া), বাঁচাইয়া, হারাধন, আবুল কালাম, আবুল হােছন, আলী মিয়া ও আলী আহমদ।
গণহত্যার সময় স্থানীয় রাজাকার আমির চাদ (চৌকিদার, ইউনিয়ন পরিষদ) যােগেশ চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক পল্লি চিকিৎসককে আদিনাথ পাহাড়ের পাশে হত্যা করে। পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে আহত হয়ে সুধীর নামের জনৈক ব্যক্তি বেঁচে যান। গণহত্যার পর শহীদদের লাশ সমাহিত করার জন্য দীপক কান্তি ভট্টাচার্য, মণীন্দ্র কুমার দাশ (মানদা), অজিত কুমার দাশ, বীরেন্দ্র দাশ (বােশইয়া) প্রমুখ ভূমিকা রাখেন। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড